অনেকদিন আগের কথা৷ আমি তখন দশ কি বারো৷ আমার গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে এক বহতা নদী, গ্রীষ্মে চর পরে, কৃষকরা আমন ধানের চারা রোপন করতো৷ বর্ষায় প্রমত্তা সেই নদী, ভরা যৌবনা৷ নৌকা চলে, শৌখিন ভ্রমনে অনেকেই বেড়িয়ে পরে৷
নদীর উপর পারাপারের জন্য প্রায় দেড়’শ ফিট লম্বা ব্রীজ৷ আগে সবাই কে যমুনার শাখা নদী বলতে শুনেছি, এখন ব্রীজের পাশে নামফলক হয়েছে, ছোট যমুনা৷
যে ঘাটে গ্রামের সবাই গোসল করতো তার অদূরেই একটা শ্বশান ঘাট আছে৷ ওদিকে সবাই ভয় নিয়েই তাকাতো৷ প্রায় সেখানে মৃতদেহ দাহ হতো৷ বর্ষার জোয়ারের পানিতে কাঠ কয়লা ভেসে আসতো গোসলের ঘাটে৷
আমিও যেতাম বড়দের সাথে মাঝে মাঝে নদীতে গোসল করতে বা কখন বৈকালিক ভ্রমনে নদীর কুলে৷ একদিনের কথা৷ দেখলাম শ্বশান ঘাটে একজন কাউকে দাহ করা হচ্ছে, একটু দূরে একটি বিশ বাইশ বছরের মেয়ে আকুল হয়ে কাঁদছে৷
আমি আমার সংগের আত্মীয় কে জিজ্ঞাসা করলাম …..খালাআম্মা মেয়েটি কাঁদছে কেন? আর উনি একা দূরে কেন, সবার থেকে আলাদা কেন?
খালাআম্মা বলল যাকে দাহ করা হচ্ছে তিনি ঐ মেয়েটির বাবা আর মেয়েটি দূরে কারন ওর কাছে আসার অনুমতি নেই৷ সে পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন৷
কিছুদিন আগে মেয়েটি একজন মুসলিম যুবক কে ভালবেসে বিয়ে করেছে৷ মুসলিম পরিবার মেয়েটিকে মেনে নিলেও মেয়েটির পরিবার মেনে নেয়নি৷ মেয়েটিকে ত্যাজ্য করা হয়েছে এবং মৃত বাবার মুখ দেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ তাই মেয়েটি দূরে দাড়িয়ে একা একা …. … ঐ বয়সেই ঘটনাটি আমাকে খুব আহত করে৷ অনেক প্রশ্ন মনে ভীর করে৷ কেন? আমার প্রশ্ন —মেয়েটি মুসলিম যুবক কে বিয়ে করে ভুল করেছে নাকি তার নিজ পরিবার তার সাথে যে নিদারুন আচড়ন করল সেটা অন্যায় হয়েছে?
একদিন সকাল বেলা খুব হৈ চৈ, নদীতে ছাদ ভেসে উঠেছে৷ সবাই বলা বলি করছে অতি প্রাকৃত কোন বিষয়, পুরাতন কোন জমিদার বাড়ি হবে হয়তবা! আমিও গেলাম অতি উৎসাহী হয়ে দেখতে৷ দেখলাম অনেকেই পানিতে নেমেছে৷ ওখানটায় পায়ের পাতা ডুবানো পানি৷ শ্বশান ঘাটটা খুব কাছেই৷ আমিও নামলাম পানিতে অনেকের সাথে এবং স্পষ্টতই দেখলাম একটা বিশাল আকৃতির ছাদ সদৃশ কিছু৷ বালু ভেদ করে জেগে উঠেছে চারকোনা …. সিমেন্টের তৈরী স্থাপনা৷ তবে আমার কাছে পুরাতন নিদর্শন বলে মনে হয়নি ! সারাদিন এই নিয়ে চলল অনেক আলোচনা ,উৎসাহ উদ্দীপনা, জল্পনা কল্পনা৷ রাত হলো ,সকাল হলো৷ পরদিন নদীর পাড়ে যেয়ে কেউ ভেসে উঠা ছাদটি দেখতে পায়নি৷ সবাই বলাবলি করল …অনেকে নাপাক শরীরে খোঁচাখুঁচি করেছে তাই হয়ত ওটা আবার ডুবে গেছে৷ কুসংস্কার ছন্ন অন্ধ সমাজ, যেমন দেখেছে তেমন করেই ভেবেছে৷ কিন্তু আমার প্রশ্ন কি ছিল ওটা যার উপর আমি নিজে হেঁটেছি???
ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি হিন্দু বাড়িতে খেলে পাপ হয়, বেহেস্ত নসীব হয়না৷ শিশু বয়েস থেকে মুসলিম ঘরের সন্তানেরা এভাবেই মানুষিক ভাবে তৈরী হয়৷ খাওয়া যাবেনা৷ আমি খেয়েছি এবং দেখেছি মুসলমান আপ্যায়নে ওরা কতটা আন্তরিক থাকে, খুশী হয়৷ এবং বিশেষ সর্তকতার সাথে খাবার পরিবেশন করা হয়৷ আলাদা করে রান্না করা, মুসলিম বাবুর্চি ডেকে এনে বিয়ে বাড়িতে রান্না করা, তা আলাদা করে পরিবেশন করে, আলাদা প্লেট আলাদা প্যান্ডেল৷ আমার প্রশ্ন ইসলাম কি এই ভেদাভেদ সমর্থন করে? হিন্দু পরিবার যে ভাতৃত্যবোধ দেখাচ্ছে তা অসর্থন কি করে ??
আমি একটি হিন্দু পরিবারের সাথে দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করেছি৷ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার৷ কাছে থেকে দেখেছি ওদের জীবন যাপনের ধরণ ৷ নিয়ম বেঁধে পুজা আর্চা করা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো, গোবর দিয়ে উঠান লেপা ……
শুনেছি প্রতিদিন কুয়াতে গোবর দিতো শুদ্ধতার জন্য৷ যে কারনে আমরা কখনও পানি খেতাম না ওই বাড়িতে৷ বরং ওই বাড়িতে গেলে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতাম, কি জানি যদি আমার কারনে ওদের কোন অনাচার হয়!
হিন্দু ঘরে জন্ম নিয়ে দিনে দিনে পারিবারিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, আচার আচরনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠা, সমস্ত নিয়ম নীতি মেনে চলা মানুষ গুলো যখন শুনি কোন দিন বেহেস্তে প্রবেশ করবে না, তখন আমার প্রশ্ন আসে মনে, কেন ??
কথা আছে ….. জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো” আপন জন্মের ব্যাপারে মানুষের নিজের কোনো ভূমিকা থাকে না। উঁচু-নিচু, ধনি বা দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হওয়াটা তার ইচ্ছা বা কর্মের ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু কর্ম জীবনে তার ভূমিকা ও অবদানের দায় তার নিজের ওপর বর্তায়। তাই পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত বিচারে তার জন্ম-পরিচয় তেমন গুরুত্ব বহন করে না। বরং কর্ম-অবদানের মাধ্যমেই মানুষ পায় মর্যাদার আসন, হয় বরণীয় স্মরণীয়।
সমাজে এক শ্রেণির লোক আছে যারা বংশ আভিজাত্যে নিজেদের সম্ভ্রান্ত মনে করেন। তারা বংশ মর্যাদার অজুহাতে সমাজে বিশেষ মর্যাদা দাবি করেন। কিন্তু তাদের এই প্রয়াস বাস্তবতা বিবর্জিত ও হাস্যকর। সমাজের নিচু তলায় জন্ম নিয়েও মানুষ কর্ম ও অবদানে বড় হতে পারে। মানব সমাজের ইতিহাসে এ রকম উদাহরণ অজস্র। পদ্ম ফুলের সৌদর্যই বড়। পঙ্কে জন্মেছে বলে তাকে হেয় গণ্য করা হয় না। তেমনি মানুষের কর্মের সাফল্যই বড়, জন্ম-পরিচয়ে মানুষের বিচার হীনমন্যতারই পরিচায়ক। বস্তুত প্রকৃতির রাজ্যে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই।
সমাজের এক দল মানুষ মানুষের উপর আধিপত্য স্থাপন করে ছোট বড় ধনী-গরিব ইত্যাদি ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় ব্যবধান রচনা করেছে মানুষই। ফলে সমাজে মানুষে মানুষে আপাতদৃষ্টে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে। তাই যে-কোন পেশা, যে-কোন কাজ মানুষ করুক না কেন, তা সমাজে গুরুত্বহীন নয়। তাকে অপ্রয়োজনীয় ও অবজ্ঞেয় করা সুস্থতার পরিচয়ক নয়। মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক বা যে কাজই করুক , সে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেটাই বিবেচ্য। মানুষের কল্যাণে সমাজের অগ্রগতিতে সে যতটা অবদান রাখে তার ভিত্তিতেই তাকে মূল্যায়ন করা হয়। সে অনুযায়ী তাকে সমাজে স্বীকৃতি দিতে হয়। বংশ পরিচয়ের অজুহাতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ, ক্ষমতা ও দম্ভের শক্তিতে মানুষের ওপর জবরদস্তি করে সমাজে মর্যদার আসন লাভ করা যায় না।
কর্মই মানুষের জীবনের আসল পরিচয়। জন্ম-পরিচয়ের উর্ধ্বে আপন কর্ম পরিচয় তুলে ধরাই মানুষের ব্রত হওয়া উচিত । তাহলেই সুকর্মের মাধ্যমে মানুষ গৌরব ও মর্যাদার আসনে আসীন হতে পারে।