সংবাদপত্র, টিভির খবর ও টক শো তে রমজান মাসে একটা প্রসঙ্গ নিয়মিতই উঠে আসে। সে হচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজারদর। নানান বিষয়ের পণ্ডিত লোকজন এ নিয়ে তাদের অভিমত খুব স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেন। ভিন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে উদাহরণ টানেন এবং দেশের ব্যবসায়ীদের তীব্র নিন্দামন্দ করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট হর্তাকর্তারা ফি-বছর দর নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ব্যর্থ হন।
এই আলোচনাগুলো আমাকে কিছুটা জিজ্ঞাসু করে তোলে। সেই জিজ্ঞাসাগুলোর কিছু কিছু লিখতে চেষ্টা করছি। যদি কেউ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানেন আর তা আমাকে জানান তাহলে আমি বেশ স্বস্তি পাব। আর এ লিখায় বাজার নিয়ে নিজের ভাবনার কথাও কিছু চলে আসবে হয়তো।
প্রশ্নগুলো:
আচ্ছা, রোজার মাসে আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের দর কেন বাড়ে এই নিয়ে কোনো বিস্তারিত গবেষণা কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান করেছেন?
সেই গবেষণা কি জনস্বার্থে প্রকাশিত হয়েছে? প্রচারিত হয়েছে?
আমাদের সাংবাদিক, টিভি-আলোচক ও কলামলেখকরা সেই গবেষণা কি হাতে পেয়েছেন?
আমাদের যারা কাঁচা ও নিত্যপণ্যের দর নিয়ে কথা বলেন, লিখেন তাদের আলোচনায় কোনো গবেষণার উল্লেখ একেবারেই থাকে না কেন? তারা কিসের ভিত্তিতে কথা বলেন, লেখেন, দেশের ব্যবসায়ীদের যাচ্ছেতাইভাবে নিন্দামন্দ করেন? তাঁদের আলোচনায় মাঠপর্যায়ের কোনো গবেষণা বা জরিপের দোহাই কোনোদিন শুনেছেন কেউ?
আমি যতটুকু খোঁজখবর রাখি, তাতে জানি যে বাংলাদেশের অনেক কিছু বদলে গেলেও নিত্যপণ্য আর কাঁচাপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর উদ্ভাবনও আমার নজরে আসেনি। হতেই পারে আমার ক্ষীণ-দৃষ্টির কারণে এসব আমার চোখে এড়িয়ে গেছে।
তবে তাকালেই দেখি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ব্যবসায়-বাণিজ্য বিষয়ে বিস্তর পড়ালেখা হচ্ছে। সেসব পড়ালেখা কী নিয়ে হয়? বিশ্ববাজার ও বৈশ্বিক পণ্য-সেবা-পরিসেবার বিপণন-ব্যবস্থাপনা-নীতি-নৈতিকতা নিয়ে? না কি বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-দোকান-কর্মী, বাংলাদেশের নিত্যপণ্য-কাঁচাপণ্যের ব্যবস্থাপনা, বাজার, বিপণন, বিপণনকর্মীদের দক্ষতা, বাজারের রাজনীতি, মাফিয়াবাজি, চাঁদাবাজি, তোলা, কমিশন ইত্যাদি নিয়েও লেখাপড়া বা গবেষণা হচ্ছে? যদি হয় তাহলে সেই সব দক্ষ -শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বাজারের শেষ মাথার কোথাও দেখি না কেন?
আচ্ছা, আমাদের কাঁচা ও নিত্যপণ্যের ক্রেতাদের বাজার-আচরণ বা চরিত্র নিয়ে বা আমাদের পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে আছে কোনো গবেষণা? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাজারে যখন প্রচুর ক্রেতার চাপ থাকে, তখন প্রতি একশ জন ক্রেতার মধ্যে অন্তত দশজন “চোর-ক্রেতা” থাকে। এদের কেউ পণ্য চুরি করে, কেউ পণ্যের টাকা না দিয়ে বা কম দিয়ে চলে যায়। দশ কেজি পোটল বেচে লাভ হয় পঞ্চাশ টাকা। আর একজন এক কেজির দাম না দিয়ে চলে গেলে হারিয়ে যায় পঞ্চাশ টাকা। এটা পাহারা দেওয়ার জন্য লোক রাখলে তাকে দিনশেষে দিতে হয় অন্তত পাঁচশ টাকা। মানে অন্তত ১০০ কেজি পণ্য বিক্রি করে পাওয়া মুনাফার টাকা!
যে পাইকার যশোর থেকে ঢাকায় বা চট্টগ্রামে আম বা লিচু কিংবা যে কোনো পচনশীল পণ্য নিয়ে পথে নামেন, তার এক ট্রাক পণ্য যখন যানজটে রাস্তায় আটকে থাকে, ক্ষতি হয় দুই/আড়াই বা পাঁচ লাখ টাকা, সেই টাকা উনি নিশ্চয়ই ক্রেতার থেকেই তুলে নেবেন? যদি না তুলতে পারেন, তাহলে বাজার থেকে সরে দাঁড়াতে হবে তাকে। তাই না কি?
আমাদের খুচরা-বিক্রেতা, রিক্সাভ্যানে যেজন পণ্য ফেরি করে ফেরেন, আমাদের মাছওয়ালা- কেমন জীবনমান তাদের? “ক্রেতার পকেট কেটে” কেমন ধনসম্পদের মালিক তারা হন, কোনো গবেষণা আছে এ নিয়ে? আড়ৎদার কিংবা যাদের আমরা মধ্যসত্বভোগী বলি তারা কেমন মুনাফা করেন, তাদের ক’জন অর্থবিত্তের মালিক হন, তাদের ক’জন ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াতে পারেন – আছে নিয়ে কোনো সমীক্ষা?
পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন চাঁদাবাজি, নানান কর্তৃপক্ষের দাবিদাওয়া মেটানো, ব্যাংকের অতি উচ্চ সুদ, নিত্য নানান বিপর্যয় নিয়ে এ দেশে যারা নিত্য ও কাঁচাপণ্যের ব্যবসায় নামেন, আপনার আমার মুখে খাবার তুলে দেন, আপনি-আমি নিত্য তাদের চোর ভাবছি, অসম্মান করছি, গালি দিচ্ছি। একবারও ভেবে দেখেছি কি, তাদের সহায়তায় আমরা কোনো ভূমিকা রেখেছি কি না? আমাদের, মানে ক্রেতাদের কোনো ভূমিকা রাখার কিছু আছে কি না? তারা তো আমাদেরই ভাই। যদি ভাইদের জন্য কিছুই না করে থাকি তাহলে তাদের গালি দিতে গলা কাঁপা উচিত না আমাদের? .. .. .. আর রাজীর-এফবি।
Top of Form
Bottom of Form