প্রফেসর মো: সেলিম উদ্দিন-
প্রায়শঃ বিভিন্ন মুসল্লী কিংবা মুরব্বীদের হাতে তাসবিহ দেখি। শৈশবের দিনগূলোতে গ্রামের মসজিদে বেশি দেখতাম। কেউ কেউ হাতের আঙুলে তাসবিহ গুনেন। সাধারণ নামাজ শেষে তাসবিহ পাঠ করতে দেখা যায়। অনেকে আবার অবসরেও তাসবিহ পাঠ করেন।উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ। পূণ্যলাভের নিমিত্তে সাধারণত তাসবিহ পাঠ করা হয়ে থাকে।অনেকে নামাজের পর এতো তাড়াহুড়ায় থাকেন পাঁচ মিনিট ব্যয় করতে পারেন না তাসবিহ পাঠের জন্য। তারা জানেন না কী নিয়ামত থেকে তারা প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছেন।
আল্লাহর প্রশংসা বাক্যই হলো তাসবিহ। তাঁর নামের তাসবিহ যে কত মধুর ও শান্তিদায়ক তা আল্লাহ প্রেমিকরাই উপলব্ধি করতে পারে। যে বা যারা ব্যক্তি জীবনে একবার হলেও তাঁর প্রেমে তাসবিহ পড়েছেন কিংবা তাঁর তাসবিহ-এর স্বাদ গ্রহণ করেছেন; তারাই জানেন যে আল্লাহর তাসবিহতে কি স্বাদ বা মহত্ম নিহিত রয়েছে।
আল্লাহ তাআলার তাসবিহ মূলত মানুষের মনের সুখ ও শান্তি লাভের এক অনন্য মহৌষধ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যারা বিশ্বাস করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়। জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণের (এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, উহা) দ্বারা অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। (সুরা রাদ : আয়াত ২৮)
অন্তরের প্রশান্তি লাভের পাশাপাশি আল্লাহর তাসবিহ আদায়ে দুনিয়া ও পরকালে বান্দার জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিদান। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে ছিলাম। এ সময় তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমাদের কেউ কি একদিনে এক হাজার নেকি অর্জন করতে সক্ষম? তাঁর সঙ্গে বসা লোকদের কেউ কেউ বললেন- ‘আমাদের কেউ কিভাবে একদিনে এক হাজার নেকী আদায় করতে সক্ষম হবেন?
তখন তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, কেউ যদি একদিনে ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ (سُبْحَانَ الله) পড়ে তাহলে তার জন্য এক হাজার নেকি লেখা হবে অথবা তার এক হাজার গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে হিব্বান, তারগিব)
আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) পিতার কাছে একজন দাসী চাইলে পিতা অপারগতা প্রকাশ করেন এবং পরে ফাতেমার গ্রহে গিয়ে আল্লাহর রাসুল বলেন – আমি কি তোমাকে এমন একটি জিনিস দেব যা তুমি যা চেয়েছো তারচে’ উত্তম? ফাতেমা (রাঃ) বললেন- অবশ্যই।
নবীজী (সাঃ) বললেন- এই কথাগুলো আমাকে জিবরাইল(আঃ) শিখিয়েছেন। প্রত্যেক নামাজের পর দশবার সুবহানাল্লাহ,দশবার আলহামদুলিল্লাহ, দশবার আল্লাহু আকবর পড়বে এবং রাতে যখন ঘুমোতে বিছানায় যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ,৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর পড়বে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে এই হাদিসের উল্লেখ আছে।
হয়রত আলী (রাঃ)একদা বলেন এই আমল আমি সর্বদা অনুসরণ করেছি। এমনকি সিফফিনের কঠিন যুদ্ধের সময়ও।
নামাজ শেষ করার পর তাসবিহ পাঠ করলে বিপদাপদ দূর হয়। অন্তরের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। তাসবিহ পাঠকারীর মনের প্রশান্তি ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। হাদিসে হজরত কাব ইবনে উজরা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক ফরজ নামাজের পরে পাঠ করার জন্য কতিপয় উত্তম বাক্য রয়েছে, সেগুলো যারা পাঠ করবে তারা কখনও নিরাশ হবে না। ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার।’ –সহিহ মুসলিম
তাসবিহ হলো গোনাহ মাফের দাওয়া। নামাজ শেষে তাসবিহ পাঠ করলে গোনাহ মাফ হয়। তাসবিহ পাঠের ফলে আল্লাহতায়ালা খুশি হয়ে বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে আল্লাহ তার সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন, যদিও গোনাহ সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।’ –সহিহ মুসলিম
নামাজ শেষে তাসবিহ পাঠ করলে সওয়াবও বেশি পাওয়া যায়। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়েছে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে আল্লাহর জিকির করেছে, তারপর দু’রাকাত নামাজ পড়েছে, তার জন্য হজ ও উমরার সওয়াবের ন্যায় সওয়াব রয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা প্রমাণ করে তাসবিহ পাঠ কত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের অনেকে এত দ্রুত তাসবিহ পাঠ করেন যে তা সহীহভাবে উচ্চারিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে কোনপ্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই।যেন শুধু নামকোওয়াস্ত পাঠ করে যাওয়া।
তাসবিহ পাঠ যদি এখলাছের সাথে খোদাভীরুতা নিয়ে পাঠ করা না হয় তাহলে কি কাংখিত সওয়াব পাওয়া যাবে? এত সহজ একটা আমল দুনিয়াবি ব্যস্ততার কারণে কত তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহকারে করা হচ্ছে!
সালাত শেষে অনেককে দেখি হাতের আঙুলে তাসবিহ পাঠ করছেন। কিন্তু এতো দ্রুত আঙুলের কড়িতে গুনা শেষ করেন যেন নিজেই জানেন না কী পড়লেন। উপরোক্ত তাসবিহ ছাড়াও আরো অনেক আমল আছে যাতে অসীম সাওয়াব রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে আমরা সেগুলো আমল করে নেকীর পাল্লাকে ভারী করতে পারি খুব সহজেই।
বুখারী শরীফের ৭০৫৩ নং হাদীসে উল্লেখ আছে-আহমাদ ইবনু আশকাব (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দুটি কলেমা (বানী) রয়েছে, যেগুলো দয়াময় আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়, উচ্চারণে খুবই সহজ (আমলের) পাল্লায় অত্যন্ত ভারী। (বানী- দুটি হচ্ছে), সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহান্নাল্লাহিল আযীম-আমরা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি, মহান আল্লাহ অতীব পবিত্র।
এসব আমলের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে পুতঃপবিত্র রাখতে পারি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথকে সহজ করতে পারি অনায়াসে। আসুন আমাদের জীবননে পরকালের জন্য প্রস্তুত করি।কঠিন দিনের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করি।