প্রফেসর সেলিম উদ্দীন-
সাওম আসে আমাদেরকে সংযমের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য। পুরো একমাস রোজা রেখে আমরা যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি তা যেন বছরের বাকী এগারমাস চর্চা করে আমাদের জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি সেটাও সিয়ামের অন্য আরেকটা লক্ষ্য।
কিন্তু আমরা কি সে প্রশিক্ষণ যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারি? সাওম বা সিয়াম আসার সাথে সাথেই আমাদের ব্যক্তিগত,পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ব্যস্ততার মাত্রা আগের তুলনায় কেমন জানি বেড়ে যায়। সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করাতো দূরে থাক ইফতারের সময় আমরা এমনভাবে নানাবিধ উপাদেয় খাদ্য দ্রবাদি উদরস্থ করি সারাদিন খেলেও আমরা এতটুকু খেতে পারতাম কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এ দৃশ্যমান ভক্ষণ প্রতিযোগিতার কারণে রামাদ্বান মাস এলেই আমাদের দেশে নিত্যকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে যায়। এতে করে সাধারণ মানুষ এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে মাহে রামাদ্বান উপলক্ষে মানুষের সুবিধার্থ খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মূল্য হ্রাস হলেও আমরা যেন এ সময় উল্টো পথেই হাঁটি। আমরা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকি বাকী এগারো মাসের ক্ষতি রামাদ্বানে পুষিয়ে নেবার জন্য।
রামাদ্বানে দান খয়রাত থেকে শুরু করে ইবাদত বন্দেগীসহ যাবতীয় পূণ্যকাজে অন্যান্য সময়ের চেয়ে সত্তর গুণ সাওয়াব বেশি।আমাদের মাওলানা ও ইসলামিক স্কলাররা এসব পূণ্যের কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা।একশ্রেণির ধনীরা এর অপব্যবহারে মেতে উঠেন নারকীয় উল্লাসে। যাকাত প্রদানের নামে গরীব মেহনতী মানুষদেরকে যেভাবে হয়রানি করা হয় তাতে লোক দেখানো এসব পূণ্যের ঠিকানা মিলবে কিনা আল্লাহ ভাল জানেন। সামান্য দুইশ টাকার শাড়ি লুঙ্গি বিতরণের নামে অনেক সময় পদদলিত হয়ে নর হত্যার মতো জঘন্য ঘটনাও ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে।
রামাদ্বান আমাদের জন্য যেন আনুষ্ঠানিকতার বার্তা নিয়ে আসে। মাহে রামাদ্বানে ইফতার পার্টির নামে যা চলে তাতে রামাদ্বানের পবিত্রতা কতটুকু বজায় থাকে সেটা বিজ্ঞরাই ভাল বিচার করতে পারবেন। ইফতার পার্টির দৌরাত্ম্যে মাগরিবের নামাজ কখন যে পার হয়ে যায় রোজাদারের সে খেয়াল থাকে না। সালাতের গুরুত্বকে পায়ে মাড়িয়ে ইফতারের পেছনে ছুটে বেড়ায় নামসর্বস্ব উপোসধারী রোজাদার।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দেখা যায় ইফতার পার্টির নামে চলে গানের আসর। নিজেদের তারকা বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করা বিভিন্ন দুনিয়াবী তারকারা যেন মাহে রামাদ্বানের চরিত্র হননের যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের পারিবারিক জীবনেও রামাদ্বান উপলক্ষে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। ওয়ারড্রব ভর্তি কাপড়চোপড় মজুত থাকার পরও রামাদ্বান মাসে নতুন কাপড় কেনার হিড়িক পড়ে যায়। বিশেষত আমাদের মহিলারা মার্কেটিং এর নামে গভীর রাত পর্যন্ত নগরীর প্রতিটি মার্কেটে চষে বেড়ান একা একা কিংবা দলগতভাবে। এতে করে মাহে রামাদ্বানের পবিত্রতা বজায় থাকা দূরে থাক নিজেদের বেলাল্লাপনা দিয়ে আমরা যেন মাহে রামাদ্বানের পবিত্রতা কিভাবে নষ্ট করা যায় তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে রামাদ্বান উপহার নামে নব্য অরাজকতা। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বিশাল আকারে ইফতারি পাঠানো,মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন সবার জন্য কাপড় চোপড় পাঠানো যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। যারা পাঠান না সেসব পিতামাতার মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কটাক্ষ সহ্য করতে হয়। এ নিয়ে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও কম ঘটেনি।এ কারণে আমাদের দেশে স্বল্পআয় ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য রামাদ্বান রহমত,বরকত,নাজাতের পরিবর্তে বাহ্যিকভাবে একবুক কষ্ট নিয়ে আসে যে কষ্টের কথা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে শেয়ার করা যায় না।
হাদিস শরীফে আরো এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না।
এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো।
আল্লাহ তায়ালা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা এ মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)।
কিন্তু আমরা যেন আল্লাহর এ নিয়ামতকে স্বচ্ছায় এড়িয়ে চলার পণ করেছি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক,রাষ্ট্রিয় জীবন কোথাও সিয়াম কিংবা রামাদ্বানের পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখার কোন প্রয়াসই আমাদের মাঝে লক্ষ করা যায় না। যারা এ মাসের পবিত্রতা ও নিয়ামতকে খুঁজে বেড়ান আমাদের সমাজ তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। রোজা রেখে যদি মিথ্যা পরিহার না যায়,সুদ,ঘুষ গ্রহণ বন্ধ না হয়,নানাবিধ অসামাজিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা না যায় তাহলে সে রোজা শুধুই উপোস ছাড়া কিছু নয়।
নবী করীম (সা.) বলেছেন, কেউ যদি (রোজা রেখেও) মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করা (অর্থাৎ উপবাস ও তৃষ্ণার্ত থাকা) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
এই মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ১টি নফল আমল করল সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এই মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করলো।
এটা ধৈর্য্যের মাস। আর ধৈর্য্যের সওয়াব হলো বেহেশত। এটা সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা সেই মাস যে মাসে মুমিন বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তা তার জন্য গুনাহ মাফের এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার ছওয়াব হবে রোজাদার ব্যক্তির সমান। অথচ রোজাদার ব্যক্তির সওয়াব কমবে না।
এসব শুনে সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ রাখেনা যে রোজাদারকে (তৃপ্তি সহকারে) ইফতার করাবে? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ পাক এই ছওয়াব দান করবেন যে রোজাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দিয়ে, অথবা একটি খেজুর দিয়ে, অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাউছার থেকে পানি পান করাবেন যার পর সে পুনরায় তৃষ্ণার্ত হবে না জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত।
আগামী জীবনে আরেকবার রামাদ্বান আসবে কিনা তা আপনি আমি নিশ্চিত নই। তাই সামনে উপস্থিত রামাদ্বানকে মুক্তির পাথেয় হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।
আসুন রামাদ্বানের শিক্ষাকে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্টিত করি। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করুন।