প্রফেসর সেলিম উদ্দীন-
মাহে রামাদ্বানে তারাবিহ সালাত আদায় নিয়ে আমরা সবাই কমবেশি স্পর্শকাতর। ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত নামাজ না পড়া ব্যক্তিও তারাবিহ পড়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে পড়েন। আমি বলবো অবশ্যই ভাল দিক। কিন্তু ফরজ নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন না করে শুধু নফল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া বরং একধরণের রিয়ার শামিল।
নফলের ফজিলত অবশ্যই আছে তবে তা ফরজ আদায়ের পর। ফরজ আদায় ব্যতীত শুধু নফল নিয়ে ব্যস্ত থেকে লাভবান হবার সম্ভাবনা নেই। কোরানে বারবার আক্বিমূস সালাত বলতে যা বুঝানো হয়েছে তা মূলত ফরজ নামাজকেই বুঝানো হয়েছে। ফরজ নামাজ পড়তে অভ্যস্ত ব্যক্তি নফলও আদায় করা সহজ হয়ে যায়।
আরেক শ্রেণির মানু্ষ আছে রামাদ্বানে খতম তারাবী পড়া নিয়েও তোড়জোড় শুরু করে দেন। মাহে রামাদ্বানের তারাবিহ নামাজে পুরো কোরআন খতম দেয়া হয় তা নিঃসন্দেহে উত্তম সওয়াবের কাজ।এতে অধিক সওয়াবের আশা করা যায়। এছাড়া আল্লাহর কালাম শুনা এটাও সুন্নত।
প্রশ্নটা অন্যখানে। আমাদের দেশে খতম তারাবীর নামে যা হয় তাতে সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের পাল্লা ভারী হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়।
প্রথমতঃ রামাদ্বানের তারাবিহকে কেন্দ্র করে প্রতি মসজিদে খতম তারাবিহ এর আয়োজন করা হয়। এতে সম্মানিত হাফেজদের তারাবিহ পড়ানোর জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। এ হাফেজ নিয়োগে চলে রমরমা ব্যবসা। হাফেজদের সাথে দর কষাকষি চলে পারিশ্রমিক নিয়ে।অথচ ইসলাম কোরান পড়িয়ে পারিশ্রমিক নেয়া সমর্থন করে না। তাহলে প্রসঙ্গত উঠে আসে হাফেজদের সম্মানী নিয়ে। এ ক্ষেত্রে কোন পক্ষই ছাড় দিতে রাজী নয়।মসজিদ কতৃপক্ষ এই খতম তারাবীহ উপলক্ষে মুসল্লীদের পক্ষথেকে চাঁদা নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা ফেদে বসেন এমন অভিযোগ প্রায়শ শুনা যায়।ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যাবে ন।
দ্বিতীয়তঃ সম্মানিত হাফেজরাও নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের সুরাহা ছাড়া আল্লাহর ওয়াস্তে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে খতম তারাবিহ পড়াতে রাজী হন না। বেশির ভাগ হাফেজরাই এটাকে রোজগারের অন্যতম মোক্ষম সুযোগ মনে করেন।হাদিয়া হিসেবে যা দেয়া হবে তাতে উনারা রাজী নন।
তৃতীয়তঃ প্রায় প্রত্যেকটা মসজিদে কমপক্ষে দুইজন কিংবা কোথাও কোথাও তিনজন হাফেজকে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে। যে কোনভাবেই হোক না কেন হাফেজরা একে অপরের পূর্ব পরিচিত কিংবা পূর্ব পরিচিত না হলেও স্বল্প সময়ে পরিচিত হয়ে যান। উনাদের মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত একটা আতাত হয়েই যায়। কেউ কারো ভুল ধরেন না। আমমুসল্লিরা সেটা টের পাবার সাধ্য আছে কি? আবার ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়। একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত কিংবা আদর্শিক কোন বৈরিতার কারণে পরস্পরের ত্রুটি খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এমনকি এর জের ধরে খতম শেষ না করে অনেক হাফেজের চলে যাবার নজিরও আছে। এক্ষেত্রে মসজিদ কমিটিতে থাকা সদস্যদের আদর্শিক ভিন্নতাও মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
চতুর্থতঃ অনেক মসজিদ কমিটি হাফেজদের ঠিক করে দেন কতোদিনের মধ্যে খতম শেষ করতে হবে। এভাবে ১০/১৫/২০/২৫/২৭ রামাদ্বান পর্যন্ত খতম তারাবিহ পড়ানোর জন্য সময় ফ্রেম নির্ধারিত হয়ে থাকে। ১০/১৫/২০ রামাদ্বানে খতম শেষ করতে গিয়ে সম্মানিত হাফেজদের উপর চাপ পড়ে। উনারা এতো তাড়াহুড়ায় কোরান পাঠ করেন যে আম মুসল্লীর পক্ষে প্রত্যকটা শব্দকে আলাদাভাবে বুঝার কোন উপায় নেই।আবার উল্টো চিত্রও আছে। হাফেজ সাহেবগণ ধীরেসুস্থে তেলাওয়াত করলে মসজিদের মুতওয়াল্লী আপত্তি দেন কিংবা প্রভাবশালী মুসল্লীরা ক্ষেপে যান। কারণ উনাদের দরকার বিশ রাকাত হলো কিনা গূনে শেষ করা কিভাবে শেষ হলো তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
সম্মানিত প্রিয় পাঠকবৃন্দ, কমবেশি এই হলো আমাদের তারাবিহ নিয়ে মাতামাতির চিত্র। সত্যিকার অর্থে আল্লাহর রহমত, বরকত ও মাগফেরাত কামনাকারী মুসলমানের সালাতে তাকওয়া ও পরহেজগারী থাকতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত জনৈক হাফেজ বন্ধুর সাথে আলাপকালে জেনেছি যে মুসল্লীদের অবস্থা বুঝে হাফেজরা ১৫/২০ পারার পর মাঝে মাঝে বাদ দিয়ে যেন সুচতুরভাবে। শুনে খারাপ লেগেছে অসুস্থ এই মন মানসিকতার জন্য। কিন্তু শুধু কি তারাই দায়ী? যারা খতমে তারাবিহ আয়োজন করেন তাদের মন মানসিকতাও এর জন্য কম দায়ী নয়।
এভাবে পবিত্র রামাদ্বান মাসে তারাবিহ নামাজ নিয়ে আমাদের প্রদর্শনী মনোভাবের কারণে পূণ্যের পরিবর্তে আমরা কী নিয়ে রামাদ্বান মাস পার করছি তা উপলব্ধি করা উচিত।
যাঁরা মক্কা-মদিনায় রামাদ্বান কাটিয়েছেন, তারাবিহ সালাত আদায় করেছেন তাঁরা কোরাআন পাঠের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তারাবিহ সালাতে । আমাদের দেশে যেভাবে বুলেট গতিতে তারাবিহ পড়ানো হয় তাতে না হয় স্বাভাবিক নিয়মে পড়ালে যা লাগতো তারচেয়ে আধ ঘণ্টা সময় কম লাগে । কিন্তু এই সামান্য সময়টুকু আমরা মসজিদে বেশি থাকতে রাজী না। নামাজ শেষে কিন্তু আমরা ঠিকই চা দোকানে বসে অহেতুক গালগল্প করে এর দ্বিগুণ তিনগুণ সময় নষ্ট করে ফেলি।
আসলে রামাদ্বান মাসে আল্লাহ শয়তানকে শেকল দিয়ে বন্দী করলেও আমরা আমাদের নফসে আম্মারার গোলামী হতে মুক্ত হতে পারি না। ফলে মাহে রামাদ্বনের নিয়ামত থেকে আমরা বঞ্চিতই থেকে যাই। আল্লাহ আমাদের নফসে আম্মারার উপর নফসে মুতমাইন্নাহকে জয়ী করে দিন।