প্রফেসর সেলিম উদ্দীন-
নেককার মুমিন বান্দার অন্তরে যখন ইখলাস পাওয়া যাবে, তখন সে ইখলাসের অনেকগুলো উপকারিতা ও গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে তা সে মুমিন বান্দা সহজেই লাভ করবে।এটা এমন এক পূণ্য যা মুমিন ব্যক্তির জীবনকে তাৎপর্যময় করে তুলবে।মুমিন বান্দা আল্লাহর আরো নিকট পৌঁছে যাবে,আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হবে।
আবু উমামা আল-বাহেলী (রাঃ)হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ)বলেন,
« إِنَّ الله لاَ يَقْبَلُ من العَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصاً، وَابتغي بهِ وَجْهُه »
“আল্লাহ তা‘আলা শুধু সে আমল কবুল করবেন, যে আমল কেবল আল্লাহর জন্য করা হবে এবং আমল দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য হবে”।
এতে করে বুঝা যায় এখলাসের কারণে আমল কবুল হয়। আবার অন্য এক হাদিস হতে জানা যায় এতে সাওয়াব লাভ হয়।
সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ)বলেন,
« إنكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبَتغِي بِها وَجْهَ الله إلِا أُجِرتَ عَلَيْهَا »
“যখনই তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কোন খরচা করবে, তার উপর তোমাকে সাওয়াব দেয়া হবে”।
ইখলাস গুনাহ মাফের অনেক বড় কারণ। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, এক প্রকার আমল এমন আছে, যখন কোন মানুষ আমলটি পরিপূর্ণ ইখলাস ও আল্লাহর আনুগত্যের সাথে করে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা এ আমলের দ্বারা তার কবিরা গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেন।যেমন- আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা) হতে হাদিস বর্ণিত, রাসূল (সাঃ)এরশাদ করেন,
« يُصاُح برَجل مِنْ أُمَّتيِ يَوَْم القِيَامَة عَلَى رُُؤوسِ الَخلَائقِ، فَيُنشْر لَهُ تسْعةٌ وتسْعونَ سِجلا، كُلُّ سِجِل مَدّ الَبصَرِ، ثُمَّ يقُولُ الله هَلْ تُنْكِرُ منْ هذَا شَيْئاً؟ فَيَقُولُ: لاَ يَا ربِّ. فَيَقُولُ: لا ظُْلمَ عَلَيْكَ. فَتخْرج لُه بِطَاقَةٌ قدْرُ الكَفِّ فيِهَا شَهادَةُ أَن لا إلَهَ إلِاَّ الله. فَيَقُولُ: أَيْنَ تَقع هذِهِ البطَِاقَةُ مَع هَذِهِ السِّجِلاَّتِ؟! فتوضُع هذِهِ البطَِاقَةُ فِي كَفَّةٍ وَالسِّجِلَّاتُ فِي كَفَّةٍ، فَثَقُلَتِ البِطَاقَةُ، وَطَاشَتِ السِّجِلاَّتُ»
“কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে সমগ্র মাখলুকের সামনে উপস্থিত করা হবে, তারপর তার জন্য নিরানব্বইটি দফতর খোলা হবে, প্রতিটি দফতর চোখের দৃষ্টির সমান দূরত্ব। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি কি এর কোন কিছুকে অস্বীকার কর, তখন সে বলবে, না, হে আমার প্রভূ। তখন আল্লাহ বলবে, তোমার উপর কোন জুলুম করা হবে না।তারপর তার জন্য হাতের তালুর সমপরিমাণ একটি কাগজের টুকরা বের করা হবে, তাতে লিপিবদ্ধ থাকবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই।তখন সে বলবে, এত গুলো বড় বড় দফতরের মুকাবেলায় এ কাগজের টুকরাটি কোথায় পড়ে থাকবে? তারপর এ কাগজের টুকরাটি একটি পাল্লায় রাখা হবে এবং দফতরসমূহ অপর পাল্লায় রাখা হবে।তখন কাগজের টুকরার পাল্লাটি ভারি হয়ে যাবে এবং দফতরসমূহ হালকা হয়ে পড়বে।
এ হল ঐ ব্যক্তির অবস্থা যে এ কালিমা ইখলাস ও একীনের সাথে বলবে যেমনটি উল্লেখিত লোকটি বলেছিল।অন্যথায় যারা কবিরা গুনাহ করার কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তাদের সবাই এ কালিমা বলে থাকে। কিন্তু তাদের কথা তাদের গুনাহের উপর ভারী হয় নাই,যেমনটি ভারী হয়েছিল এ লোকটির কথা। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত,
إنَّ امْرَأَةً بَغِيا رََأْت كَلباً فِي يَوٍْم حَارٍّ يطيِفُ ببِئر قَدْ أَْدلَعَ لسَِانَهُ مِن العَطَشِ، فنَزَعْت لَه بمُوقِهَا – أي: سقته بخفها- فَغُفِرَ لهَا
“একজন ব্যভিচারী মহিলা একটি কুকুরকেএকটি কুপের নিকট দেখতে পেল সে পানির পিপাসায় কাঁতরাচ্ছে। মহিলাটি তার পায়ের মোজা খুলে তাকে পানি পান করালে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন”।যেহেতু মহিলাটি তার অন্তরে গাথা বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ ঈমান নিয়ে কুকুরটিকে পানি পান করালেন, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।অন্যথায় যত ব্যভিচারী মহিলা কোন কুকুরকে পানি করাবে সবাইকে ক্ষমা করে দেবেন এমন কথা এখানে বলা হয়নি।
আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে হাদিস বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَن سَأَلَ الشَّهَادَةَ بصِدْقٍ بَلَّغَه الله مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ؛ وَإنْ مَاتَ عَلَى فرِاشهِ »
“যে ব্যক্তি অন্তর থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট শাহাদাত কামনা করবে, আল্লাহ তাকে শহীদদের মর্যাদা দান করবে যদিও লোকটি বিছানায় মারা যায়।
অনুরূপভাবে ধনী লোক তার সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে যে পরিমাণ সাওয়াব লাভ করে থাকে, একজন গরীব লোক তার নিয়ত ভালো হওয়ার কারণে সেআল্লাহর রাস্তায় দান না করেও অনুরূপ সাওয়াব লাভ করবে।আবু কাবশা আল-আনমারি (রাঃ)হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَثَلُ هَذِهِ الأمُّةِ كَمثَلِ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ: رَجُلٌ آتَاهُ الله مَالا وَعِلْمًا، فَهُوَ يْعَملُ فِي مَالهِِ يُنفِقُهُ فِي حَقِّهِ، وَرَُجلٌ آتَاهُ الله عِلْمًا وَلَم يُؤْتهِِ مَالا فَهُوَ يَقُولُ: لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذي يْعَملُ قَال فَهُمَا فِي الأجر سَواءٌ »
“এ উম্মতের উপমা চার শ্রেণীর লোকের অনুরূপ। এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা‘আলা মাল ও জ্ঞান উভয়টি দান করেছেন। লোকটি তার মালকে যথাযথ ব্যয় করে। আর এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞান দান করেছে, তাকে মাল দেয় নাই। সে মনে মনে বলে, যদি আমার নিকট লোকটির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমিও তার মত ব্যয় করতাম।রাসূল (সাঃ) বলেন, তারা উভয়ে সমান সাওয়াবের অধিকারী হবেন।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন, তা হল, একজন লোক আমলে অক্ষম নয়, তবে সে কাজ করার আশা রাখে, কিন্তু করে না।আর সে ধারণা করে, তাকে তার ভালো কাজের আশার কারণে সাওয়াব দেয়া হবে।সে তার এ ধরনের নিয়তকে নেক নিয়ত বলে বিবেচনা করে।কিন্তু বাস্তবতা হল, এ ধরনের নিয়ত ও আশা শয়তানের ওয়াস-ওসা ও আত্মার ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।
একজন মানুষ মসজিদে সালাতের জামাতে উপস্থিত না হয়ে, ঘরে বসে থাকে বা বিছানায় শুয়ে থাকে, আর বলতে থাকে আমি সালাতে যাওয়াকে পছন্দ করি বা সালাতে উপস্থিত হতে চাই। সে ধারণা করে যে, তার এ কথা দ্বারা, মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে সালাত আদায় করার সাওয়াব সে লাভ করবে এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা উল্লেখিত বিষয়সমূহের সাথে কোন সম্পর্ক নাই এবংরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিসসমূহের সাথেও এর কোন সম্পর্ক নাই।
সা’আদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনুহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« إنِّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتغِي بها وَجْهَ الله إلِا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ »
“আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তুমি যে দান কর, তার উপর অবশ্যই তুমি সাওয়াব পাবে।এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে খাওয়ারের যে লোকমাটি তুলে দাও”। [তাতেও সাওয়াব পাবে]
এটি কল্যাণের অধ্যায়সমূহ হতে একটি বিশাল অধ্যায়। যখনই একজন বান্দা তাতে প্রবেশ করবে, সে মহা কল্যাণ ও অসংখ্য প্রতিদান লাভ করবে। আর আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বৈধ কর্মগুলো ও স্বাভাবিক কাজকর্ম দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের ইরাদা করি,তাহলে আমরা বিশাল প্রতিদান ও অধিক সাওয়াবের অধিকারী হব।
যাবিদ আল-ইয়ামি রহ. বলেন, প্রতি কর্মে এমনকি খানাপিনারও নিয়ত করাকে আমি পছন্দ করি। বাস্তব কিছু নমুনা তোমার সামনে তুলে ধরা হল, যাতে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগাতে পারি।
অনেকেই এমন আছে, সে সুগন্ধি ব্যবহার করতে অধিক পছন্দ করেন।সে যদি মসজিদে যাওয়ার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করে আল্লাহর ঘরের ইজ্জত করার নিয়ত করে এবং মানুষ ও ফেরেশতাদের কষ্ট রোধ করার নিয়ত করে তাহলে সে অবশ্যই সাওয়াবের অধিকারী হবে।
আমরা সবাই খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে বাধ্য।কিন্তু আমরা যদি আমাদের খাদ্য ও পানীয়দ্বারা আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করার উপর শক্তি লাভ করার নিয়ত করে থাকি তাহলে আমরা অবশ্যই সাওয়াব লাভ করব।
অধিকাংশ মানুষ বিবাহ করতে বাধ্য।যদি একজন লোক বিবাহ দ্বারা এ নিয়ত করে, নিজের ও স্ত্রীর সতীত্বের হেফাজত করা এবং এমন নেক সন্তান রেখে যাওয়ার যারা তারপর আল্লাহর জমিনে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করবে, তাহলে তাকে অবশ্যই সাওয়াব দেয়া হবে।
বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রদের অবশ্যই তাদের উদ্দেশ্য সুন্দর হওয়া উচিত।একজন ডাক্তার ডাক্তারি শিক্ষা দ্বারা মুসলিমদের স্বাস্থ্য-সেবা দেয়ার নিয়ত করবে। অনুরূপভাবে একজন ইঞ্জিনিয়ার মুসলিমদের সেবা করার নিয়ত করবে।মোট কথা, প্রতিটি ছাত্র ইসলাম ও মুসলিমদের খেদমত করার নিয়ত করবে।তাহলে সে তার অধ্যয়ন ও পড়া-লেখা দ্বারা সাওয়াবের অধিকারী হবে।