আমাদের ইবাদত কিংবা আমল যা-কিছু করি না কেন তাতে ইখলাস থাকলে সে ইখলাস যেমন পরকালে আমাদের মুক্তিকে সহজ করবে, আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে তেমনি আমাদের ইবাদত,আমল,নিয়ত ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইখলাস না থাকলে আমরা অনেক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাব। ইখলাসের অভাবে আমরা যা হারাতে পারি তা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
জান্নাতে প্রবেশ না করা: আবু হুরাইরা (রাঃ)হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ)বলেন,
« مَن تَعلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بهِِ وَجْهُ الله لا يَتَعلَّمُه إلِا ليُصيبَ بِه عرضاً مِنْ الدُّنْيَا لَم يَجدْ عَرف الجَنةَِّ يْوَم القياَمةِ يعْنِي رِيحَهَا »
“যে ইলম দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়ে থাকে, সে ইলমকে যদি কোন ব্যক্তি দুনিয়াবি কোন উদ্দেশ্যে শেখে, কিয়ামতের দিন সে জান্নাত পাবে না, এমনকি সুঘ্রাণও পাবে না”।
কিয়ামতের দিন জাহান্নামে প্রবেশ করা: আবু হুরাইরা(রাঃ)হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,আমি রাসূল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি-
“কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে, তিনি হলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হন, তারপর তাকে ডাকা হবে এবং তার নিকট তার নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে সে তা চিনতে পারবে।তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ সব নিয়ামতের মুকাবালায় কি আমল করছ? সে বলল, তোমার রাহে আমি যুদ্ধ করছি এবং শহীদ হয়েছি। সে বলল, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি যুদ্ধ করছ, যাতে মানুষ তোমাকে বাহাদুর বলে। তা তোমাকে বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়। এক ব্যক্তি ইলম অর্জন করল, মানুষকে শেখাল এবং কুরআন পড়ল। তারপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হল এবং তার উপর আল্লাহর নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পেল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করছ? বলল, আমি ইলম শিখেছি এবং শিখিয়েছি।তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছি।সে বলল, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি ইলম শিখেছ, যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়। আর কুরআন তিলাওয়াত করেছ, যাতে তোমাকে এ কথা বলা হয়, লোকটি ক্বারি। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়।(মুসলিম: ১৯০৫)
এক ব্যক্তি তাকে আল্লাহ তা‘আলা সামর্থবান করেছেন এবং তাকে বিভিন্ন ধরনের ধন-সম্পদ দিয়েছেন।তারপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হল এবং তার উপর আল্লাহর নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতেপেল।তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করছ? বলল, তোমার জন্য তুমি যে পথে ব্যয় করাকে পছন্দ কর, সে ধরনের কোন পথ আমি ছাড়িনি যেখানে আমি তোমার জন্য ব্যয় করিনি। বলল, তুমি মিথ্যা বলছ, তবে তা করছ, যাতে লোকেরা তোমাকে এ কথা বলা হয়, লোকটি দানবীর। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু যখনই এ হাদিসটি বর্ণনা করার ইচ্ছা করতেন, হাদিসের ভয়াবহতার কারণে তিনি বেহুশ হয়ে পড়তেন।সুফাই আল আসবাহী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি একবার মদিনায় প্রবেশ করে, দেখতে পান যে, একজন লোককে কেন্দ্র করে অনেক মানুষ একত্র হয়। তখন সে বলল, লোকটি কে? লোকেরা বললেন, লোকটি আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু।আমি তার নিকটে গিয়ে তার সামনে বসলাম। তিনি মানুষকে হাদিস শোনাচ্ছেন। যখন তিনি চুপ করলেন এবং একা হলেন, আমি তাকে বললাম, আমি তোমাকে সত্যের শপথ দিয়ে বলছি। তুমি আমাকে এমন একটি হাদিস বলবে, যা তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জবান থেকে শুনেছ,বুঝেছ এবং জেনেছ। তখন আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু বলল, আমি তাই করব, আমি তোমাকে একটি হাদিস শোনাবো যে হাদিসটি আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন এবং আমি হাদিসটি তাঁর থেকে বুঝেছি এবং শিখেছি। এ কথা বলে কিছু সময় আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু বেহুশ হয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরে আসলে তিনি বলেন, আমি তোমাকে একটি হাদিস শোনাবো যে হাদিসটি আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট এ ঘরের মধ্যে বর্ণনা করেছেন, যেখানে আমি ও তিনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।তারপর আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু আবারও বেহুশ হয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরে পেলেন। তিনি তার চেহারা মুছলেন এবং বললেন, আমি তোমাকে একটি হাদিস শোনাবো যে হাদিসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বর্ণনা করেছেন, যখনআমি ও তিনি এ ঘরের মধ্যে ছিলাম। আমাদের সাথে আমি ও তিনি ছাড়া আর কেউ ছিল না। তারপর আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু আবারও বেহুশ হয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরে পেলেন। তিনি তাঁর চেহারা মুছলেন এবং বললেন, আমি তোমাকে একটি হাদিস শোনাবো যে হাদিসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বর্ণনা করেছেন, যখন আমি ও তিনি এ ঘরের মধ্যে। আমাদের সাথে আমি ও তিনি ছাড়া আর কেউ ছিল না। না। তারপর আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু আবারও কঠিন ভাবে বেহুশ হয়ে পড়লেন এবং তিনি তাঁর চেহারার উপর ঢলে পড়লেন, আমি তাকে লম্বা করে আমার আমার উপর হেলান দেওয়ালাম, কিছুক্ষণ পর সে হুশ ফিরে পেল এবং বলল, আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস বর্ণনা করেন…তিনি উল্লেখিত হাদিসটি বর্ণনা করেন। হাদিসের শেষ অংশে বর্ণিত, “অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার উভয় হাঁটুর উপর আঘাত করে বলেন, হে আবু হুরাইরা! এরা তিনজনই আল্লাহ তা‘আলার প্রথম মাখলুক যাদের দ্বারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামকে প্রজ্বলিত করা হবে।মনে রাখবে, আগুনকে যেদিন প্রথম প্রজ্বলিত করা হবে, সেদিন হত্যাকারী, ব্যভিচারী, চোর ও মদ্যপানকারী দ্বারা প্রজ্বলিত করা হবে না, বরং কুরআন তিলাওয়াতকারী, দানকারী, মুজাহিদ প্রমুখদের দ্বারা প্রজ্বলিত করা হবে আর এ গুলো সবই হবে রিয়ার কারণে।
(তিরমিযি: ২৩৮২,হাকেম রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।)
কায়াব বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনুহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ طَلَبَ العِلَم ليِجَاري بهِِ العُلَمَاءَ، أَوْ ليِمَارِيَ بهِِ السُّفَهَاءَ، أَوْيَصْرِفَ بِهِ وجُوَه الناَّسِ إِلَيْهِ؛ أَدْخَلَهُ الله النَّارَ »
“যে ব্যক্তি এলম তালাশ করে, যাতে ইলম দ্বারা আলেমদের মুকাবালা করে অথবা জাহেলদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে অথবা মানুষের দৃষ্টি তার প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে”।
(তিরমিযি: ২৬৫৪, আল্লামা আল-বানী রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন)
আমল কবুল না হওয়া:
«قَالَ الله تَبَارَكَ وَتَعالَى: أَنَا أَغْنىَ الشركَاءِ عَنْ الشِّركِ، مَنْ عِمَل عَمَلًا أَشرك فِيهِ مِعي غَيْري تَرَكْتُه وشَركهُ »
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা আমার সাথে যে সব শরীকদের শরীক সাব্যস্ত কর, আমি তা হতে পবিত্র। যে ব্যক্তি কোন আমল করে,তাতে আমার সাথে অন্য কাউকে শরিক করে, আমি তার আমল ও শিরক উভয়টিকে ছুড়ে ফেলে দেই।(মুসলিম: ২৯৮৫)
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনুহু হতে বর্ণিত,তিনি বলেন,
أن رجلا قال: يا رسول الله، رجل يريد الجهاد في سبيل الله وهو يبتغي عرضا من عرض الدنيا، فقال النبي صلى الله عليه وسلم « لاَ أَجر لَهُ » فأعظمَ ذلك الناسُ، وقالوا للرجل: عد لرسول الله صلى الله عليه وسلم فلعلك لم تفهمه. فقال: يا رسول رجل يريد الجهاد في سبيل الله وهو يبتغي عرضا من عرض الدنيا. فقال: « لا أَجَر لَهُ » فقالوا للرجل: عد لرسول الله صلى الله عليه وسلم فقال له الثالثة، فقال له « لا أَجَر لَهُ »
“এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! একজন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় পার্থিব বা দুনিয়ার কিছু সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে জিহাদ করতে চায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার জন্য কোন সাওয়াব মিলবে না।লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথায় আশ্চর্য হলেন এবংলোকটিকে বললেন, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আবার যাও এবং জিজ্ঞাসা কর, হতে পারে তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কথাটি বুঝিয়ে বলতে পারনি।তারপর লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে গিয়ে আবারও বলল, হে আল্লাহর রাসূল! একজন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় দুনিয়ার কিছু সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে জিহাদ করতে চায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার জন্য কোন সাওয়াব মিলবে না।লোকেরা বলল, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আবার যাও, লোকটি আবার গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তৃতীয় বার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার জন্য সাওয়াব ও বিনিময় কিছুই নাই।(নাসায়ী: ৩১৪০, আল্লামা আল-বানী রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন)
আমলের সাওয়াব নষ্ট হওয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٖ فَجَعَلۡنَٰهُ هَبَآءٗ مَّنثُورًا ٢٣ ﴾ [الفرقان: ٢٣]
হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত, আল্লাহ তা‘আলা রিয়াকারীদের বিষয়ে বলেন,
«اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُم تُراءُونَ فِي الدُّنيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تِجدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً »
“দুনিয়াতে তোমরা যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে তাদের নিকট যাও, দেখ, তাদের নিকট কোন বিনিময় পাও কিনা”?
(আহমদ: ২৩৬৮১। আল্লামা আল-বানী রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।)