প্রফেসর সেলিম উদ্দীন-
মানুষ সামাজিক জীব। সঙ্গতকারণে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ পৃথিবীতে পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্র নিয়ে বসবাস করে আসছে। সৃষ্টির সেরাজীব আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মর্যাদা দেয়ার পর মানুষের জীবন বিধান কিরূপ হবে তা আল্লাহ তায়ালা কুরআন এবং রাসূল সাঃ এর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ মানুষ তা জেনেও গাফেল থাকে আর বাকী অংশ কখনো জানার চেষ্টা করে না। ফলে অজ্ঞতা আর নাফরমানী গোটা মানব জাতিকে গ্রাস করে নিচ্ছে।
আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করলে আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি দয়া এবং অনুগ্রহ করেন। কিন্তু মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে নিজেদের ইচ্ছেমত জীবনযাপন করতে শুরু করে তখন মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিজেদের জন্য ডেকে নিয়ে আসে।আমাদের জীবনে বিপদ আপদ আসার অন্যতম কারণ আল্লাহর অবাধ্যতা। তবে কিছু কিছু বিপদ আপদ আসে মুমিন বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য।
এ সম্পর্কে আল্লারাব্বুল আলামিন সুরা বাকারার ১৫৫ ও ১৫৬ আয়াতে ঘোষণা করেছেন-‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয় ক্ষুধা সম্পদ জীবনের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। হে নবি! ধৈর্যধারণকারীদের আপনি সুসংবাদ দিন যখন তারা বিপদ পড়ে তখন বলে নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাবো।’
বিপদ-আপদের মাধ্যমেই মানুষ তার গোনাহ থেকে মুক্তি পায়। আর যদি বিপদে আক্রান্ত মানুষের গোনাহ না থাকে তবে ওই ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা আরো বেড়ে যায়। তাই মুমিনদের হতাশ হয়ে মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে আল্লাহর রহমত পেতে থাকে। হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে-হজরত আবু সাঈদ খুদরি ও হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলিম ব্যক্তির ওপর যেসব যাতনা রোগ ব্যধি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দুঃশ্চিন্তা কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয়। এমন কি যে কাটা তার দেবে বিদ্ধ হয় এ সবের দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারি)
যুগে যুগে নবি-রাসুল, অলি-আউলিয়া ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ওপর বিপদ-আপদ এসেছে। তারা নানান বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ধৈর্যশীল বান্দা ও পয়গাম্বর হলেন হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম।
হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর সব সম্পদ সন্তান-সন্তুতি ও স্ত্রীদের হারিয়েছিলেন। রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় এলাকার লোকজন তাঁকে নিজ এলাকা থেকে বিতাড়িত করেছিল। তাঁর সাথে তার এক স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না।
রোগাক্রান্ত হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের সারা শরীরের পচন ধরে পোকার সৃষ্টি হয়। তবুও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহকে ভুলে যাননি। ধৈর্যহারা হননি এবং আল্লাহর কাছে তাওবা ইসতেগফার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করেছেন। আল্লাহর দয়ায় তিনি রোগ মুক্ত হয়ে পুনরায় আবার তার সব সম্পদ সব কিছু তিনি ফিরে পেয়েছিলেন।
আল্লাহ পাকের আরেক পয়গাম্বর হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম। যিনি নিজ অঞ্চল ত্যাগ করার সময় নৌকায় পথ পাড়ি দিতে গিয়ে নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। নদীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বড় একটা মাছ তাকে গিলে ফেলে। এহেন বিপদের মুহূর্তে হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত ছিলেন না। সে কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা আম্বিয়ায় তুলে ধরেন-
“এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ কর। যখন সে আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের ওপর রাগ করে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমি তাঁর ওপরে কোনোরূপ কষ্টদানের সিদ্ধান্ত নেব না। অতপর সে মাছের পেটে ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করল।(হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম বললেন)-لا إِلَهَ إِلا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَউচ্চারণ : লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জ্বালিমিন।অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি ব্যতিত কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভূক্ত। অতপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম। এবং তাকে দুঃশ্চিন্তামুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমি বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৭-৮৮)
এ দোয়াটি হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামের দোয়া বা দোয়া-ই ইউনুছ নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘বিপদগ্রস্ত কোনো মুসলমান যদি নেক মাকসুদ হাসিলের জন্য এ দোয়ায়ে ইউনুছ পড়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সে দোয়া কবুল করেন।’
জাগতিক যেসব কারণে মানুষের উপর বিপদ নেমে আসে তা মানুষের কামাই।বিভিন্নভাবে এই বিপদ আসতে পারে। নিম্নে আমরা তার কয়েকটি কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো,ইনশাআল্লাহ।
১.ব্যক্তিগত জীবনে বিপদ আপদঃ
পাঁচ ওয়াক্ত নামায আল্লাহ তায়ালা ফরয করেছেন। যখন কেউ নিয়মিত ভাবে ফরয নামায আদায় করে তখন সে আল্লাহ তায়ালার জিম্মায় চলে যায়। অপরদিকে বান্দা যখন ইচ্ছাকৃত ও জেনে বুঝে ফরয নামায ছেড়ে দেয় তখন সে আল্লাহর জিম্মা তথা দায়িত্ব থেকে বেরিয়ে যায় এবং তখন সে নিজের ও সৃষ্টির দায়িত্বে থেকে যায়। ফলে এই অবস্থায় তার যেকোন দুরবস্থা ঘটতে পারে। হাদিসে এসেছে,
“কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে ফরয নামায ছেড়ে দিলে তার উপর থেকে আল্লাহ তায়ালার দায়িত্ব উঠে যায়।” – ইবনে মাজাহ
সুতরাং বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পেতে সবার আগে পাঁচ ওয়াক্ত নামায সময় মত আদায় করতে হবে। এই নামাযের ব্যাপারে কোরান হাদিসে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।আখিরাতে সর্বপ্রথম হিসেব নেয়া হবে নামাযের। এখানে যে কৃতার্থ হবে জান্নাতের পথ তারজন্য সুগম হবে।
২. ব্যবসায় বাণিজ্যে বরকত হীনতাঃ
অনেকে ব্যবসা বাণিজ্য করেন কিন্তু দেখা যায় নানাপ্রকার বালামুসিবত তার পিছু ছাড়ে না। ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি হচ্ছে না বলে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখা যায় অনেককে। আসলে এটাও এক ধরণের বিপদ। কিন্তু বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে না নিজের কৃতকর্মের কারণে ব্যবসায়িকভাবে তার সফলতা আসছে না।
রাসূল সাঃ বলেছেন,
“ব্যবসায় অধিক পরিমাণে কসম খাওয়া থেকে বাঁচো। কারণ কসম পণ্য বিক্রি করিয়ে দেয় কিন্তু পরে বরকত খতম করে দেয়।”– সহীহ মুসলিম
এছাড়া আরও কয়েকটি কারণে ব্যবসায় বরকত কমে যায় যথা: সুদের পণ্য, ওজনে কম দেয়া, হারাম পণ্যের মিশ্রণ,খাবার অবৈধ ভাবে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির জন্য মজুদ করে রাখা ইত্যাদি।
এসব কারণে ব্যবসায় বরকত চলে যায়। এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে অনেকে তো হারাম পথে ব্যবসায় করে কোটিপতি হচ্ছে। কোটিপতি হওয়া আর আল্লাহর বরকত দুটি ভিন্ন বিষয়। প্রথমত তার পরকালের স্থান জাহান্নামে করে নেয় এবং তার এই হারাম উপার্জন করে সে তার অন্তরে এবং পারিবারিক ভাবে প্রশান্তি পায় না। সবচেয়ে বড় কথা হল পরকালের স্থান যদি জাহান্নামে হয় তবে দুনিয়ার জীবনে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার মালিক হয়ে কি লাভ?
৩. অত্যাচারী শাসকঃ
বান্দা যখন আল্লাহর অবাধ্য হয় আল্লাহ তায়ালা তখন বান্দার উপর অত্যাচারী শাসক চাপিয়ে দেন। শান্তির আশায় বিপ্লব ঘটিয়ে কোন নতুন দল বা লোক ক্ষমতায় আনা হলেও কার্যত তা ব্যর্থ চেষ্টা হবে। ধনী-গরিব, ইতর-ভদ্র সবাই আল্লাহর অবাধ্যতায় থাকবে আর শাসক পাল্টাতে থাকবে, এভাবে কখনও অবস্থা উন্নত হবে না। জগদ্দল পাথরের মতো স্বৈরাচারী শাসক অবাধ্য জাতির ঘাড়ে চেপে বসবে এবং আল্লাহর শাস্তি ভোগ করতে তাহকবে। তবে একমাত্র আল্লাহ তায়লার উপর তাওয়াককুল, আল্লাহর সকল হুকুম সঠিক ভাবে পালন, আল্লার নিকট সসর্বোতভাবে নিজেকে সোপর্দ করা এবং তাঁর নিকট দোয়া কান্নাকাটির মাধ্যমেই কেবল ভাল শাসক জুটতে পারে।
হাদিসে এসেছে,
“তোমরা যেমন হবে, তোমাদের উপর বাদশাহ তথা শাসনকর্তাও তেমনি চাপিয়ে দেয়া হবে।”-মেশকাত।
পক্ষান্তরে, আমরা যদি সৎ ও সৎকর্মী হই, তাহলে আল্লাহ তায়লা আমাদের জন্য সৎ ও দয়ালু শাসক নিয়োগ করবেন।সৎ ও যোগ্য শাসক আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য নেয়ামতস্বরূপ।
৪.নতুন নতুন রোগ-ব্যাধিঃ
নতুন নতুন রোগ ব্যাধির জন্ম নেয়া এবং তাতে ব্যাপকহারে মানুষের প্রাণ হারানো এটাই মানুষের কৃতকর্মের ফল।
হাদিসে এসেছে,
“রাসূল সাঃ এরশাদ করেছেন, যে জাতি-সম্প্রদায়ে (তথা সমাজে) প্রকাশ্যে অশ্লীল কর্ম সম্পাদিত হতে থাকবে, তাদের মাঝে অবশ্যেই প্লেগ বিস্তার লাভ করবে এবং এমন ধরনের রোগ ব্যাধি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পাবে, যা তাদের বাপ দাদাদের মাঝেও কখনও হয়নি।”– ইবনে মাজাহ
বর্তমান পৃথিবী তার অন্যতম উদাহরণ। আমাদের সংস্কৃতি থেকে শুরু করে চাল-চলন, জীবন-যাপন সব কিছুতে অশ্লীলতা। অশ্লীলতা এখন আর গোপনে নয় বরং প্রকাশ্যে বিল-বোর্ডে, টেলিভিশনে, পার্টিতে সব জায়গায়। নগ্ন হওয়াকে বলা হয় সাহসিকতা, যিনাকে বলা হয় স্বাধীনতা আর নিজেকে অন্যের কাছে বিলিয়ে দেওয়াকে বলা হয় সৌন্দর্য চর্চা। আর এত কিছুর ফলাফল কি হচ্ছে তা আমাদের চোখের সামনেই দৃশ্যমান।
সুতরাং কঠিন এবং মহামারী রোগ-ব্যাধি থেকে বাঁচতে হলে প্রথমে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনাকে দূর করতে হবে।
৫.দুর্ভিক্ষ এবং আতংকঃ
হযরত আমর ইবনুল আস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি, “যে জাতির মাঝে ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে, তাদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে পাকড়াও করা হয়, আর যাদের মাঝে উৎকোচ (ঘুষ) বিস্তার লাভ করে, তাদেরকে পাকড়াও করা হয় ভীতি ও আতঙ্কের মাধ্যমে।” (মুসনাদে আহমদ)
এই হাদিসটি দ্বারা একসাথে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল। অর্থ্যৎ দুর্ভিক্ষের কারণ ব্যভিচার আর আতঙ্কের কারণ ঘুষ। সুতরাং এসব বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হলে এসব খারাপ কাজ পরিহার করতে হবে।