বাংলাদেশী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দিলিপ রাস্তোগি ৭০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন, যদিও তিনি এখনও শরীর ও মনের দিক থেকে নিজেকে অল্পবয়সী ভাবেন। সামাজিক সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ তাকে অপছন্দ করেন কারন এই মুহুর্তে তার বয়স ১০৯ বছর। তবে তিনি তার বয়স ৬০ বছর মনে করেন। মিঃ রাস্তোগি বলেছেন যে দীর্ঘায়ুর গোপনীয়তা রক্তনালীতে নির্ভর করে। যদি রক্তনালী সুগঠিত এবং স্বাস্থ্যকর হয়, তবে আপনি ১২০ বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন, এমনকি অনুভব করবেন সম্পূর্ণ সুস্থ। কার্ডিওলজিস্টরা সম্পূর্ণরূপে এই বিবৃতি নিশ্চিত করেছেন।
এটা সাধারন ব্যাপার যে, দেহের অঙ্গ ও সিস্টেমের কার্যকারিতা রক্তের মানের উপর নির্ভর করে সঞ্চালিত হয়। রক্ত সঞ্চালনের অর্থ অভ্যন্তরীণ অঙ্গ গুলিতে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করার পাশাপাশি কার্বনডাই অক্সাইড এবং বিপাকীয় দ্রব্য সংগ্রহ। শৈশব, কৈশোরে, যৌবনে, আমরা বেশী চলাচল করি ফলে রক্তনালী গুলি নতুন, স্থিতিস্থাপক, সুগঠিত – তখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পুষ্টি সর্বাধিক থাকে। বয়সের সাথে সাথে আমরা কম চলাচল করি তখন আমাদের রক্তনালী গুলি মলিন হতে শুরু করে। অনেক গুলি কারণেই এটা হয়ে থাকে। সবকিছু ক্ষতিকারক নয় কিন্তু ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাবার, নিম্ন পরিবেশ, আলস জীবনধারা সমস্যা তৈরী করে। তবে প্রাকৃতিক লিপিড ব্লক তৈরি বা জমা করা একটি সাধারণ প্রক্রিয়া যা সব প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান।
‘খারাপ’ রক্তনালী অর্থ কী?
কল্পনা করুন মরিচা পূর্ণ কিছু পাইপ। কি হচ্ছে? পানির চাপ বাড়ছে তাতে পানির প্রবৃত্তি খারাপ হয়। রক্তের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে রক্তনালীর উপর যখন কোলেস্টেরল বা অন্যান্য পদার্থ জমা হয় তখন রক্তচাপ বাড়ে। (খারাপ’ রক্তনালী গুলি উচ্চ রক্তচাপের প্রধান কারণ!), তখন রক্তে অপরিশোধিত দ্রব্য থাকে, রক্ত সঞ্চালন কমে যায় ফলস্বরূপ শরীরের সমস্ত অঙ্গ এবং সিস্টেমে পরিবর্তন ঘটে এমনকি ত্বকও একটি সিস্টেম। আপনি যদি যত্নবান হন এবং আপনার রক্তনালীগুলি পরিষ্কার করেন তবে আপনার সম্ভাবনা রয়েছে বেশি দিন বেঁচে থাকার। অঙ্গ বা জয়েন্টে ব্যথা অনুভব না করে শরীর কাজ করবে দুর্দান্তভাবে। অন্য কথায়, রক্তনালীগুলি পরিষ্কার করে আপনার জীবন এবং স্বাস্থ্যকে দীর্ঘায়িত করতে পারেন।
রক্তনালীর অপরিশোধিত দ্রব্য নিম্নলিখিত রোগগুলির উপস্থিতির কারণ হতে পারে:
অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস : রক্তনালী ভালভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়, ছোট ছোট রক্তনালী গুলি পুরোপুরি ব্লক হয়ে যায়, এবং মূল রক্তনালী গুলিতে কোলেস্টেরল উচ্চ মাএায় জমে থাকে।
ইসকেমিক হৃদরোগ : এটি করোনারি রক্তনালির নিয়মিত রক্তের ঘাটতির কারণে ঘটে। যা রক্তনালি থেকে অপরিশোধিত দ্রব্য বহন করে।
স্ট্রোক : সেরিব্রাল টিস্যুতে রক্ত সরবরাহের দুর্বলতা গুলি স্নায়ুবিক সংবেদনশীলতা অনুভবে মৃত্যু ঘটায়, যা কিছু নির্দিষ্ট ফাংশন কে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপ : রক্তনালী গুলি থেকে অপরিশোধিত দ্রব্যর কারনে লুমন সংকীর্ণ এবং বৃদ্ধি ঘটায় রক্তচাপের।
ভেরিকোজ শিরা : এগুলি শরীরের অভ্যন্তরে আবির্ভূত হয় কেবল পায়ে নয় (যা মহিলাদের জন্য উদ্বেগজনক)। হেমোরয়েড এর পরিণাম হলো শিরা প্রসারণ ।
ভেনাস এবং ধমনী থ্রোম্বোসিস : রক্তনালীতে জমে থাকা অপরিশোধিত দ্রব্যগুলি থ্রোম্বি গঠন করে রক্তনালীর মৃত্যু ঘটায়, যা কোনও অঙ্গ থেকে কোষের একটি গ্রুপের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যদি থ্রোম্বাস শিথিল করে এবং রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে তবে হৃদয়ের রক্তনালী গুলি ব্লক হতে পারে, কার্ডিয়াক সিস্টেম গতিরোধ হতে পারে, যা ৭০% ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর ঘটাতে পারে।
রক্তনালীর জমাট বাধা সম্পর্কে উপলব্ধির প্রধান লক্ষণগুলি
(ক) মাইগ্রেন (মাথার তীব্র ব্যথা)
(খ) স্মৃতিশক্তি প্রতিবন্ধকতা
(গ) দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি
(ঘ) অনিদ্রা
(ঙ) অন্তরঙ্গ সমস্যা
(চ) দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণ বন্ধকতা
(ছ) উচ্চ রক্তচাপ
(জ) শ্বাসকষ্ট এবং বুক ব্যাথা
(ঝ) পায়ে ফ্যাকাশে চামড়া
(ঞ) পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা
আপনার এই লক্ষণগুলির মধ্যে যে কোন একটি লক্ষণ থাকুক বা নাথাকুক, ৩০ বছর বয়সের পরে, কমপক্ষে ৫ বছরে একবার রক্তনালী পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এইভাবে আপনার স্বাস্থ্য দৃঢ় থাকবে। রক্তনালী গুলির অপরিশোধিত দ্রব্য সংগ্রহ করার ক্ষমতা রয়েছে, বিশেষত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে। এই জন্য দিনভর বার্গার বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার দরকার নেই। সসেজ বা ভাজা ডিম খাওয়ার পরেও নির্দিষ্ট পরিমাণে কোলেস্টেরল রক্তের কোষে জমা হবে, যা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাবে।
রক্তনালী গুলি পরিষ্কার করার পদ্ধতি :
অনেক দেশে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এইটি। এই রোগের প্রধান ঝুঁকি হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক, যা ধমনী বাধাপ্রাপ্ত বা উচ্চ মাত্রায় খারাপ কোলেস্টেরলের দরুন হয়। কম চলাফেরা করা বিশেষ করে অস্বাস্থ্যকর খাদ্য হৃদরোগের দিকে পরিচালিত করে। কিন্তু যদি আপনার খাদাভ্যাস সামান্য পরিবর্তন করেন, তাহলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক কমাতে পারেন।
হৃদপিণ্ডে রক্তসরবরাহকারী ধমনী পরিষ্কার করতে সহায়তা করে এমন কিছু খাবার ও পানীয় এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো :
১। কমলার রস : বিশুদ্ধ কমলার রস অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় ধমনীর জন্য উপকারী। এছাড়া এটা সকলেরই জানা যে, কমলার রস রক্তচাপ কমায়। প্রতিদিন ২ কাপ কমলার রস পান, আপনার শরীরে সাধারণ ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরণ, ভিটামিন এবং মিনারেল সরবরাহে যথেষ্ট।
২। বাদাম : বাদামে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর চর্বি বিদ্যমান, বিশেষ করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং অসম্পৃক্ত চর্বি। বাদাম শরীর থেকে খারাপ কোলেস্টেরল স্তর কমায়, এছাড়াও শরীরের জয়েন্টগুলো এবং মস্তিষ্কের স্মৃতির জন্য দরকারী। খাদ্যতালিকায় আখরোট এবং কাজুবাদাম রাখতে ভুলবেন না।
৩। হলুদ : হলুদে কারকুমিন নামক একটি উপাদান থাকে, যা অত্যধিক চর্বি জমা প্রতিরোধ এবং টিস্যুর প্রদাহ হ্রাস করে। হলুদ দিয়ে চা পান কিংবা তরকারিতে মশলা হিসেবে খাদ্যতালিকায় নিয়মিত রাখুন হলুদ।
৪। কফি : এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ২-৪ কাপ কফি পান হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ২০ শতাংশ কমায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, কফি আপনার পাকস্থলীতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন ভালো নয়।
৫। স্যামন মাছ : সুস্থ হার্টের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাবারগুলো একটি হচ্ছে, স্যামন মাছ। এই মাছে অনেক স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে, প্রদাহ প্রতিরোধ করে। এছাড়া হার্টের জন্য অন্যান্য ধরনের মাছও উপকারী। যেমন টুনা, হেরিং এবং ম্যাকেরল।
৬। পারসিমন : ফাইবার সমৃদ্ধ ফল পারসিমন কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
৭। গ্রিন টি : গ্রিন টিতে শক্তি এবং শান্তি উভয় প্রভাব রয়েছে। চা পাতায় টিসেটাহিনু নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে। দিনে এক বা দুই কাপ গ্রিন টি পান রক্তনালীর উপকারে যথেষ্ট।
৮। তরমুজ : গ্রীষ্মের এই ফলটি শরীরকে শুধু সতেজ করে তোলে না, পাশাপাশি শরীরে নাইট্রিক অ্যাসিড উত্পাদনে অবদান রেখে রক্ত বাহন প্রসারিত করে। এমনকি এক টুকরো তরমুজ অনেক আশ্চর্য কাজ করে।
৯। পনির : মাঝারি পরিমানে পনির রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
১০। ক্র্যানবেরি : পটাসিয়ামের একটি দারুন উত্স ক্র্যানবেরি। আপনি যদি নিয়মিত ক্র্যানবেরি জুস পান করেন তাহলে সুস্থ কোলেস্টেরল স্তর বৃদ্ধি এবং খারাপ কোলেস্টেরল স্তর হ্রাস পাবে। এটা প্রমাণিত যে, দিনে ২ গ্লাস ক্র্যানবেরি জুস পান করলে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে।
১১। দারুচিনি : দারুচিনি শুধু দারুন মশলা চা বা রান্নার স্বাদ বাড়াতে সীমাবদ্ধ নয়। এছাড়াও এটি উচ্চ কোলেস্টরলের সঙ্গে সংগ্রাম করে ধমনী সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। বাস্তব প্রভাব পেতে, প্রতিদিন ১ চা-চামচ যথেষ্ট।
১২। ডালিম : ডালিমে রয়েছে প্রচুর ফাইটোকেমিক্যাল, যা শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে উন্নত করতে স্বাভাবিক নাইট্রিক অক্সাইড উত্পাদনে অবদান রাখে।
১৩। পালংশাক : ধমনী পরিষ্কার এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে পালংশাক। এটি পটাসিয়াম এবং ফোলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ। এই উভয় উপাদান হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস এবং পেশী টিস্যু বজায় রাখে।
১৪। অলিভ ওয়েল : ইতালীয় এবং গ্রীকদের দীর্ঘকাল সুস্বাস্থ্যের গোপন রহস্য হচ্ছে- উচ্চ মানের অলিভ ওয়েল। খাদ্যতালিকায় অলিভ ওয়েল রাখলে, শরীরে স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং কোলেস্টেরল হ্রাস পাবে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৪১ শতাংশ কমাতে পারে অলিভ ওয়েল।
১৫। ব্রোকলি : এই সবুজ সবজিটি ভিটামিন কে সমৃদ্ধ, আপনার ধমনীতে ক্যালসিয়াম জমা প্রতিরোধ করবে, যা রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য দরকারী। ব্রোকলি খুবই পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি সবজি হিসেবে পরিচিত।
১৬। অ্যাভোকাডো : পুষ্টিকর ফলগুলোর মধ্যে অ্যাভোকাডো একটি। এই ফলের মধ্যে থাকা ফ্যাট, ভালো এবং খারাপ কোলেস্টেরলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে, যা আমাদের ধমনীর জন্য অত্যাবশ্যক।
১৭। অ্যাসপারাগাস : এই সবজিটি শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল ধ্বংস করে। শ্বাসকষ্ট এবং ধমনীর প্রদাহ রোধ করে।