স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে । সে সময়ে শুধুমাত্র প্রিন্ট মিডিয়া ও রেডিও’র মাধ্যমে দেশের আম-জনতা দেশ -বিদেশের খবর পেতেন । যদিও রেডিওর সহজলভ্যতা বর্তমান সময়ের মত এত ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল না । তৎকালীন প্রেক্ষাপটের আলোকে রেডিও তথা বেতারকে বর্তমানের স্যাটেলাইট এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে । সে সময়ে বিশেষ করে মফস্বল ও জেলা শহরগুলোতে অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে দৈনিক পত্রিকা পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে যেত । এতদসত্ত্বেও আম-জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়তো দেশ- বিদেশের খবর নিতে । শহর-বন্দর -গ্রাম- গঞ্জের হাট-বাজারগুলোর টি – স্টলে দৈনিক পত্রিকার খবর একজন পড়ত এবং সেখানে উপস্থিত দেশ বিদেশের খবর জানতে আগ্রহী উৎসুক অসংখ্য পাঠকরা মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ করতেন এবং পত্রিকায় উল্লেখিত সংবাদ এর আলোকে নিজেদের মতো বিচার-বিশ্লেষণ করতেন । দৈনিক ইত্তেফাকের শ্রদ্ধেয় মরহুম জনাব তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, প্রয়াত জনাব নির্মল সেন , চারণ সাংবাদিক খ্যাত মরহুম জনাব মোনাজাতউদ্দিন , বিবিসি বাংলা বিভাগের তৎকালীন দায়িত্বরত মরহুম জনাব আতাউস সামাদ , মরহুম এম আখতার মুকুল সহ আরো অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিকের নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হতো সমগ্র বাংলাদেশে ।
সময়ের বিবর্তনে আকাশ সংস্কৃতির প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বিশ্বব্যাপী আবির্ভাব ঘটে স্যাটেলাইট গণমাধ্যমের , স্বাধীন বাংলাদেশে আছড়ে পড়ে তার ঢেউও । এরই ধারাবাহিকতায় ৯০ দশকের একেবারে শেষের দিকে বিপুল বিস্ময় ও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আবির্ভাব ঘটে স্যাটেলাইট গণমাধ্যমের । একুশে টিভি ও এটিএন বাংলা রীতিমতো সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় । এরই ধারাবাহিকতায় চ্যানেল আই, এনটিভি, চ্যানেল ওয়ান, মাই টিভি, সিএসবি নিউজ , ইসলামিক টিভি, দিগন্ত টিভি, এটিএন নিউজ, সময় টিভি সহ আরো অনেক স্যাটেলাইট গণমাধ্যম এর আবির্ভাব ঘটে । উক্ত স্যাটেলাইট গণমাধ্যমসমূহ ব্যাপক সাড়া ফেলে জনমানসের হৃদয়ে ।
বর্তমানে চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এর সাথে সাথে প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষতায় ( ফেসবুক ,টুইটার, মেসেঞ্জার , হোয়াটসঅ্যাপ) বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশে ও ব্যাপকভাবে আবির্ভাব ঘটে অনলাইন গণমাধ্যমের। ” মুহুর্তের খবর মুহূর্তের মধ্যে” জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়ে রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে গণমাধ্যম জগতে এই অনলাইন গণমাধ্যম । কাজের আধিক্য ও যান্ত্রিক জীবনের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ জনগণের কাছে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এই অনলাইন গণমাধ্যম এর । স্যাটেলাইট গণমাধ্যমের সাথে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে বেশকিছু অনলাইন গণমাধ্যম ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও আস্থা অর্জন করে নিয়েছে জনগণের হৃদয়ে । তবে সঠিক নীতিমালা ও স্বচ্ছ জবাবদিহিতার অভাবে কতিপয় অসাধু ব্যক্তি জনপ্রিয় এই গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থের পাশাপাশি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে । এছাড়া রুচি ও মানহীন সংবাদ পরিবেশন, যাচাই-বাছাই বিহীন সংবাদ প্রকাশ ও দুষ্কৃতিকারীদের শিরস্ত্রাণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে । তবে এদের সংখ্যা মুষ্টিমেয় । এই মুষ্ঠিমেয় সংখ্যাধিক্যের কারণে জনপ্রিয় অনলাইন গণমাধ্যম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে না । ইতিমধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় অনলাইন গণমাধ্যমকে নীতিমালায় আনার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে । এরই ধারাবাহিকতায় , সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তথ্যমন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে অসংখ্য অনলাইন গণমাধ্যম রেজিস্ট্রেশন এর জন্য আবেদন করেছে এবং তা বর্তমানে যাচাই বাছাই এবং প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে । এতদসত্ত্বেও ঈর্ষাপরায়ণতা অথবা ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে সম্প্রতি একটি স্যাটেলাইট গণমাধ্যম ঢালাওভাবে অনলাইন গণমাধ্যম এর প্রতি ব্যাপক বিষেদাগার করেছে , যা অনভিপ্রেত । কারণ অনলাইন গণমাধ্যমগুলো নীতিমালায় আসার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক তারা যথাযথ কাগজপত্র জমা তথা পরীক্ষা দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ে, যেভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয় শিক্ষা বোর্ডগুলোর নিয়ন্ত্রণে । অনলাইন গণমাধ্যমগুলো পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি ……. ফলাফল প্রকাশ না হওয়ার আগে এই ধরনের ঢালাও বিষাদাগার কাম্য নয় মোটেও । এছাড়া কতিপয় গণমাধ্যমকর্মী একে অপরকে বারিধারা, উত্তর ধারা ও মূলধারা বলে কটাক্ষ করে থাকে । যা সত্যিই দৃষ্টিকটু ও লজ্জাজনক । গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে তবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয় । কোলের বাচ্চা শিশু যখন মল-মূত্র ত্যাগ করে তখন সে বাচ্চার কাপড় পরিবর্তন করা হয় , শিশু বাচ্চাটিকে ফেলে দেওয়া হয় না । ঠিক তেমনি বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনলাইন গণমাধ্যমের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না । দৃষ্টিকটু ও লোক হাসানো কাঁদা ছোড়াছুড়ির অবসান ঘটিয়ে স্যাটেলাইট ও অনলাইন গণমাধ্যম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে দৃঢ় আশাবাদ সাধারণ জনগণের ।
তানভীর আহমেদ
( গণমাধ্যমকর্মী )