ভোটার যাকে তার ভোট দিচ্ছেন তার অর্থ হচ্ছে, ভোটদাতা সংশ্লিষ্ট ভোটপ্রার্থী সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ‘ওই প্রার্থী সংশ্লিষ্ট কাজ (রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন পাস এবং জনগণের সার্বিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি) এর যথাযথ যোগ্যতা রাখেন। প্রয়োজনীয় সততা ও আমানতদারীও রয়েছে তার মধ্যে।’ এখন বাস্তবে যদি ওই প্রার্থীর মধ্যে সেসব যোগ্যতা ও গুণ অনুপস্থিত হয় এবং তা সত্ত্বেও ভোটদাতা জেনেশুনেই তাকে ভোট দেন তাহলে
সেটা হবে মিথ্যা সাক্ষ্য, যা বড় মাপের কবিরা গোনাহকোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে ভোটদানের বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টিকে আমরা কয়েকটি প্রেক্ষাপট থেকে আলোচনা করতে পারি। যেমনÑ
‘শাহাদত’ বা ‘সাক্ষ্য প্রদান’ একটি প্রেক্ষাপট হচ্ছে ‘শাহাদত’ বা ‘সাক্ষ্য প্রদান’। ভোটার যাকে তার ভোট দিচ্ছেন তার অর্থ হচ্ছে, ভোটদাতা সংশ্লিষ্ট ভোটপ্রার্থী সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ‘ওই প্রার্থী সংশ্লিষ্ট কাজ (রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন পাস এবং জনগণের সার্বিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি) এর যথাযথ যোগ্যতা রাখেন। প্রয়োজনীয় সততা ও আমানতদারিও রয়েছে তার মধ্যে।’ এখন বাস্তবে যদি ওই প্রার্থীর মধ্যে সেসব যোগ্যতা ও গুণ অনুপস্থিত হয় এবং তা সত্ত্বেও ভোটদাতা জেনেশুনেই তাকে ভোট দেন তাহলে সেটা হবে মিথ্যা সাক্ষ্য, যা বড় মাপের কবিরা গোনাহ। এতে করে ভোটার হবেন মিথ্যুক এবং কবিরা গোনাহের অধিকারী। নবীজি (সা.) মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরক-অপরাধের পরবর্তী পর্যায়ের অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন। (মিশকাত)। অন্য আরেকটি হাদিসে মহানবী (সা.) মিথ্যা সাক্ষ্যকে অন্যতম ‘কবিরা গোনাহ’ বলে এরশাদ করেছেন। (বোখারি ও মুসলিম)। সুতরাং ভোটদাতাকে নিজ পরকাল ও পরিণতি বিবেচনা করে ভোটদান তথা সাক্ষ্য দিতে হবে। শুধু প্রথাগত সম্মান বা লাজলজ্জায় অথবা কোনো লোভলালসা ও ভয়ভীতির কারণে নিজকে ওই মহাক্ষতির মুখোমুখি করতে যাওয়া ঠিক হবে না। শাফায়াত’ বা সুপারিশ ভোটের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত বা ইসলামী ব্যাখ্যা হচ্ছে, ‘শাফায়াত’ বা সুপারিশ অর্থাৎ ভোটদাতা যেমন সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিচ্ছেন, তার মানে তিনি সুপারিশ করছেন। এ সুপারিশ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে যা বলা হয়েছে তা সব সংশ্লিষ্ট ভোটার বা ভোটদাতার সম্মুখে থাকা অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভালো ও সৎকাজে সুপারিশ করবে সে ওই ভালো কাজের ও নেকির মধ্যে অংশ পাবে; আর যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজে বা খারাপ বিষয়ে সুপারিশ করবে সেও সেই মন্দের অংশীদার হবে।’ (সূরা নিসা : ৮৫)। ভালো বা উত্তম সুপারিশ হচ্ছে এটাই যে, যথোপযুক্ত ও সৎ আমানতদার ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করা, যিনি আল্লাহর সৃষ্টির হক অধিকার ঠিকঠাকভাবে আদায় করবেন। আর মন্দ সুপারিশ হচ্ছে অযোগ্য, অপদার্থ-পাপী-অপরাধী বা কোনো সন্ত্রাসীর পক্ষে সুপারিশ করে তাকে গণমানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে সুযোগ করে দেওয়া। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের ভোট দ্বারা পাস করে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী তার তিন বছর বা পাঁচ বছরের সময়ের মধ্যে যত রকম নেক বা বদ কাজ করবে তার সে সব কাজের সওয়াব বা আজাবে আমরাও নিশ্চিত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। সুতরাং সাধু সাবধান!
‘ওকালত’ বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করাভোটদানের তৃতীয় আরেকটি ব্যাখ্যা ‘ওকালত’ বা কাউকে উকিল বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করা। অর্থাৎ একজন ভোটদাতা যে প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, তাকে নিজের ও জনগণের প্রতিনিধি বা উকিল নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু এই প্রতিনিধি নির্বাচন বিষয়টি যদি ভোটদাতার একার বা ব্যক্তিগত বিষয়ে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হতো তাহলে তার লাভ-ক্ষতি শুধু তার নিজের একার ব্যাপারে সীমিত থাকত এবং সে তার একার জবাবদেহিতার মুখোমুখি হতো। অথচ স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারটি তেমন নয়। কেননা ওই প্রতিনিধি নিযুক্তি এমনসব হক-অধিকার সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে; যার মধ্যে তার সঙ্গে পুরো জাতি অংশীদার। তাই যদি কোনো অযোগ্যকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধিরূপে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হয় তাহলে পুরো জাতির সমূহ হক-অধিকার বিনষ্টের সব গোনাহ সেই ভোটদাতার আমলনামায়ও যোগ হবে। তার ভোট দেওয়ার কারণে উত্তীর্ণ মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপি-মন্ত্রীরা যত পাপের ভাগী হবেন সমপরিমাণ পাপের ভাগী সংশ্লিষ্ট ভোটার বা ভোটদাতা নিজেও হবে। কেননা, ভোটদাতার ভোটে পাস করেই তো এতগুলো অন্যায়-অপকর্ম করার সুযোগ পেলেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি তথা তারই নিযুক্ত উকিল সাহেব। ভোটপ্রার্থীর ভাবনার বিষয়কোনো সভা-সংসদ বা পরিষদের সদস্য হওয়ার উদ্দেশ্যে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে যিনি প্রস্তুত হন তিনি যেন পুরো জাতির সামনে দুটি বিষয়ে দাবি বা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যথাÑ একটি হচ্ছে, ‘তিনি ওই কাজ বা দায়িত্ব সম্পাদনে যোগ্যতা রাখেন যার জন্য তিনি প্রার্থী হয়েছেন।’ দ্বিতীয়তটি হচ্ছে, ‘তিনি আমানত ও সততার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করবেন।’ এখন বাস্তবে যদি তিনি সংশ্লিষ্ট কাজে যোগ্যতাসম্পন্ন হন এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জাতির সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্বাচনের ময়দানে আসেন তাহলে তার ওই পদক্ষেপ অনেকটা বৈধ সীমার ভেতরেই গণ্য করা যায়। তবে এক্ষেত্রেও শরিয়তসম্মত উত্তম পন্থা হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি যেন নিজে নিজের যোগ্যতার ও সেবার কথা প্রকাশ করে প্রার্থী না হন বরং মুসলমানদের কোনো দল বা জামাতের পক্ষ থেকে তাকে যোগ্য বিবেচনা করে যেন তার নাম প্রস্তাব করে এবং তাকে দায়িত্ব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
পক্ষান্তরে যার মধ্যে তেমন দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্যতা নেই, তার পক্ষে দাঁড়ানো বা তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পূর্ণ অবৈধ ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমন ব্যক্তির প্রার্থী হওয়াই জাতির সঙ্গে প্রতারণা এবং দেশ ও জাতির খেয়ানতের নামান্তর। আর সদস্য হিসেবে পাস করে দেশ ও জাতির সর্বনাশের কারণ হওয়ার ব্যাপারটি তো পরে হবে। প্রথম ধাপেই তিনি বিশ^াসঘাতক ও খেয়ানতকারীরূপে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। কারণ তিনি অযোগ্য, দেশ ও জাতির সংশ্লিষ্ট গুরুদায়িত্ব বহন করার এবং সততা ও আমানতদারির সঙ্গে তা পালন করার যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। তাই এখন থেকে যিনিই কোনো আইনসভা, রাজ্যসভা, স্থানীয় সরকার বা সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের ছোট-বড় কোনো সদস্যপদের প্রার্থী হবেন, তার যদি পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় থাকে তাহলে নির্বাচনের এ ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার আগে তিনি নিজেই যেন নিজের পরীক্ষা নিয়ে নেন। তিনি যেন এমনটি ভাবেনÑ এ দায়িত্ব নেওয়ার আগে তার দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা শুধু নিজের ও নিজ পরিবার-পরিজন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কেননা, হাদিসের নির্দেশ অনুযায়ী ‘প্রত্যেক মানুষ নিজ পরিবার ও অধীনদের ব্যাপারেও দায়িত্বশীল।’ আর এখন থেকে অর্থাৎ কোনো আসনের সদস্যপদে নির্বাচিত বা মনোনীত হওয়ার পর থেকে এ আসনের সব জনগণ এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব রকম দায়-দায়িত্ব ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের সার্বিক জবাবদিহিতা তার নিজের ঘাড়ে চেপে বসল। এ জন্য তাকে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।
শরিয়তের দৃষ্টিতে ভোটার ও ভোটপ্রার্থী
