গাযীয়ে দ্বী’নে মিল্লাত আল্লামা সূফী শায়খ ছৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রহঃ)
শাহজাদা ছৈয়্যদ মুহাম্মদ সারোয়ার আজম
বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি খ্যাত চাটিগাঁ তথা চট্টগামের রাউজান থানার অর্ন্তগত হালদা নদীর কুল ঘেষা কাগতিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন গাযীয়ে দ্বীনে মিল্লাত রাহনুমায়ে শরীয়ত সূফী আল্লামা শায়খ ছৈয়্যদ মুহাম্মদ আব্দূল জলিল (রহঃ)। তাঁহার পিতা হযরত মাওলানা মফিজ উল্লাহ মিরজী রহ. ছিলেন বুযর্গ ব্যক্তি এবং মহিয়ষী মাতাও ছিলেন খুবই ফরহেযগার ,যার প্রমাণ মেলে হুযুর কেবলার মাতা তাঁহার পিতার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে তাঁহার পিতা শুদ্ধ করে কোরআন তেলাওয়াত করতে পারে কিনা তা পরীক্ষা নেয়ার পর বিবাহ করেন । এরকম বুযর্গ ব্যক্তিদের মাধ্যমে হুযুর কেবলা দুনিয়াতে ১৩১১ হিজরী ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দ রোজ জুমাবার , সুবহি সাদিক্ব এর সময় এ ধরায় তশরীফ এনে দুনিয়ার বুকে ইবাদত-বন্দেগী,খাওয়া-দাওয়া,আচার-আচরন তথা নিজের জীবন ,পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রিয় জীবন কিভাবে পরিচালিত করতে হয় তা নিজের জীবন পরিচালিত করে রাছুলে পাক সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়াছাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জন করে মানব সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যান। হুযুর কেবলার পিতৃ বংশ ছিল আরবীয় পুর্বপুরুষ । উনার পৈত্রিক নিবাশ ছিল রাউজান থানার অন্তর্গত কদলপুর,মিরাপাড়ায়। তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা এসেছিলেন কাগতিয়ায় দ্বীনি শিক্ষা দেয়ার জন্যে , সম্ভ্রান্ত বংশীয় পরিবারের (প্রকাশ মনু মিঞাজী বর্তমানে বাঁশখালী স্থায়ী নিবাস) মেয়েকে শাদী করে কাগতিয়ায় বসতি স্থাপন করেন । তিনি শিশু বয়স থেকে অন্যান্য শিশুদের থেকে ব্যতীক্রম ছিলেন,অল্প সময়ে প্রাইমারী শিক্ষা ও উনার মহীয়ষী আম্মাজান থেকে কোরআন তেলোয়াত শিক্ষা নেন । হুজুর কেবলার পড়ালেখার প্রতিভা দেখে তাঁহার পিতা সুদুর দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন পড়ালেখার জন্যে , দিল্লি দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে দস্তারবন্দী (দাওরায়ে হাদীছ) করে বাংলাদেশে ফিরে এসে তৌহিদ ও রেছালতের তথা আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রচার কার্যে (ওয়াজ মাহফিল) শামিল করেন। উল্লেখ্য যে হুজুর কেবলা দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেও সবসময় ওহাবীদের বিরোদ্ধে কঠোর ছিলেন । পারিবারিক ভরণ-পোষনের জন্য দ্বী’নি ইসলামের খেদমতের পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবসা করেছিলেন। তিনি ইবাদত রেয়াজতে হুজুর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) এর পূর্ণাঙ্গ অনুসারী ছিলেন। হুজুর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম যেভাবে সাংসরিক জীবন চালিয়েছেন ঠিক তেমনি ভাবে হুজুর কেবলার জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হন। পরে সময়ের স্বল্পতার কারনে ব্যবসা বন্ধ করে দ্বী’নি ইসলামের খেদমতে বাকী জীবন ব্যয় করেন । সংসারে অভাব অনঠনে পরলেও আল্লাহ ও রাছুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে অল্প উপার্জনে সন্তুষ্ট থাকতেন। কখনো নিজের অভাব অনঠনের কথা কারো নিকট প্রকাশ করতেননা । বরঞ্চ পরোপকারের জন্য অর্থাৎ গরীব এতিম অনাথ অসহায়দের সাহায্যে হাত প্রসারিত রাখতেন। অভাবের মধ্যে থেকেও অথিথি ব্যতীত একবেলা আহার করেননি। তিনি কোরআন হাদিছ, ফিকাহ ইত্যাদির জ্ঞান অর্জন অর্থাৎ জাহেরী জ্ঞান অর্জন করার পর বাতেনী জ্ঞান তথা সিনা-বা-সিনার জ্ঞান আহরণের জন্য বেতাগী দরবার শরীফের মহান পীরে দস্তগীর গৌছে জামান হাফেয হাকীম শাহ্ মুহাম্মদ বজলুর রহমান মহাজেরে মক্বি (রহঃ) ছাহেবের হাতে বায়াত গ্রহণ করে ছূফীবাদের হাতেকড়ি নেন। দুনিয়াবী স্বার্থে কারো সাথে হিংসা বিদ্বেষ অপছন্দ করতেন , দুনীয়াবি লোভ লালসা ত্যাগ করে শুধুম্াত্র আল্লাহ ও তাঁর রাছুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম)এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কঠিন রেয়াজত করেছেন। যার ফলশ্রæতিতে বেতাগী দরবার থেকে ১৯৪৬ সালে১৩৬৭ হিজরীর ৮ই ছফর তাহাঁর পীরছাহেব কেবলা প্র্রথমে খেলাফত দান করে তাঁর ডান পাশে বসিয়েছিলেন। আপন পীরের প্রতি এতই মহব্বত রাকতেন যে আপন পীর মুর্শিদ যা বলতেন তা পালন করার জন্য কখনো কালক্ষেপন বা সময়/ শরীরের অশুস্থতা/বার্দ্বক্য ইত্যাদি চিšতা করতেননা । আপন পীর মুর্শিদ যা বলতেন তা পালন করার জন্য সদা প্র¯তুত থাকতেন । হুজুর কেবলা সবসময়ে ইবাদত রেয়াজত গোপনে করার চেষ্টা করতেন। যাতে কোন অহংকার প্রকাশ না হয়।তিনি যেভাবে চলতেন ঠিক সেভাবে মুরিদান ও মুহিব্বিনদের বলতেন ’ ওয়া ফরজ নামায মছজিদে পড়িবে আর নফল এবাদত গরত (ঘরে) পড়িবে এতেই মঙ্গল’ হুজুর কেবলার যার জন্য দোয়া করতেন আল্লাহপাক তা কবুল করতেন। তিনি চলার পথে সবসময় থলের মধ্যে মিছওয়াক,তছবিহ,দালায়েলুল খায়রাত ,ও একটি লুঙ্গি রাখতেন । হাটঁতে হাঁটতে তিনি কয়েক খতম খতমে খাজেগান শরীফ পাঠ করতেন অর্থাৎ চলতে ফেরতে ইবাদতে মশগুল থাকতেন যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ক্বোরানুল করিমে বলেন হুজুর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম)হচ্ছে উত্তম আদর্শ এই উক্তিটি হুজুর কেবলার জীবনে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) আদর্শ পরিস্ফুটিত হয় উদাহারণ স্বরূপ বলা যায় যেমন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) কম আহারী ,কম ঘুমানো ,নিজের কাজ নিজে করা ,নিজের কাপড় নিজে সেলায় করা ,আতœীয়তা সুদৃঢ় করা যেমন হযরত আলী (রাঃ) কে নিজের মেয়ে সাদী দেয়া ,আল্লাহর পথে স্ব-শরীরে জিহাদ করা ইত্যাদি হুজুরকেবলা ও ঠিক এভাবে নিজের জীবনকে প্রিয় নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) রঙ্গে রাঙ্গীয়েছেন । জিহাদের নবীকরিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) দাঁত মোবারক শহীদ হওয়ায় কতটুকু কষ্ট অনুভব করেছেন তাও হুজুর কেবলার দিল্লীতে একটি মসজিদ প্রতিষ্টা করাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ হয় ঐ যুদ্ধে হুজুরকেবলা স্ব-শরীরে যোগদান ও নেতৃত্ব দিয়ে বৃটিশ বাহিনীকে পরাস্ত করে মুসলিম কাফেলা জয় লাভ করে ঐ যুদ্ধে তিনি বৃটিশ বাহিনীর গোলায় আঘাত প্রাপ্ত হন। এছাড়াও হুযুর কেবলা উত্তর রাউজানে রায়দীঘির পাড়ে মুসলমানদের কবরস্থান হিন্দুরা রাস্তা তৈরী করতে চাইলে আশ-পাশের মুসলিম পল্লী থেকে এর প্রতিবাদ করে এক পর্যায়ে এটি যুদ্ধে রূপ নেয় ঐ যুদ্ধে হুযুর কেবলা কাগতিয়া হতে ৮/১০ জনের মুজাহিদ কাফেলা নিয়ে শরীক হন। ঠিক এভাবে প্রতি গর্হিত তথা ইসলামী শরীয়তের বিপরীত কাজকে ঘৃনা করতেন। এবং অন্যায়-জুলুম ও অত্যাচারের বিরূদ্ধে সবসময় সেচ্ছার থাকতেন। এভাবে প্রতিটি কর্মে হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের আদর্শ তাঁর জীবনে পরিস্ফুটিত হয়েছে। শুধু তাই নয়,শিশু অবস্থায় নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) পুত্র ইন্তিকালে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম)এর কি কষ্ট অনুভব করেছেন তাও হুজুর কেবলার নিজ পুত্র (দুইবছর ছয় মাস বয়সি) ইন্তিকাল হওয়াতে সেই কষ্ট ও অনুভব করেছিলেন । এক কথায় বলতে গেলে হুজুর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম) এর কদম-বাকদম ভাবে চলেছেন। যুরকানী ৪র্থ খন্ডে উল্লেখ রয়েছে হুজুর নবীয়ে পাক (দরূদ)বলেন আল্লাহ তা’আলা আমাকে ফরমায়াছেন যদি আপনি চান আমি মক্কার প্রস্তরময় ভূমিকে স্বর্ণময় বানিয়ে দেব। আমি আরজ করলাম ,হে আল্লাহ না বরং আমি এটাই চাই যে , একদিন পরিতৃপ্ত থাকব আরেকদিন ভুখা থাকব। যখন ভুখা থাকব ,তোমার সমীপে ক্রন্দন ও মিনতি করব এবং মনে প্রানে তোমাকে স্বরণ করব আর যখন পরিতৃপ্ত থাকব , তোমার কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা করব। পকৃত পক্ষে এটায় হচ্ছে হুজুর নবী ( দরূদ) এর ছুন্নত । তিনিও ঠিক এভাবে খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করেছেন,তিনি সমসাময়িক সব সময় বলতেন পেঠের চার ভাগের দূই ভাগ খাবার আর এক ভাগ পানি আর এক ভাগ খালি রাখবে তাতে এবাদতে অলসতা আসবেনা । এ নিয়মে তিনি সবসময় চলতেন । তাঁর কখনো উপাধির প্রতি মোহ ছিলনা, হজ্ব করে আসার পর উনার এক মুরিদ হুজুর কেবলাকে বলেন হাজি রূমাল কাঁেধ জড়াতে , তিনি বলেন আমাকে কি হাজী সাহেবের টাইটেল দিতে হবে ? অর্থাৎ নিজেকে সবসময় গোপন করে রাখার চেষ্টা করতেন । হুযুর কেবলার পীর-মুর্শিদ কারামত প্রকাশ করা অপছন্দ করতেন তাই তিনি কারামত প্রকাশিত হোক এটা থেকে নিজেকে বাচিঁয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। তবুও কারামত প্রকাশ হয়েযেত ,যেমন ঘরে আহার না থাকলেও মেহমানদের আহার করানো, দোয়া করে বৃষ্টি বন্ধ করা , মহুুর্তে স্থান ত্যাগ করা অন্য যায়গায় একই সময়ে উপস্থিত হওয়া কঠিন মৃত্যু যন্ত্রনায় (ছাখরাতের সময়) মুরিদানকে সাহায্য করা অসংখ্য কারামত প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সবসময় হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম কে অনুসরণ করতেন, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম যে ভাবে জীবন নির্বাহ করেছেন ঠিক সেভাবে নিজের জীবন নির্বাহ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি কখনো উচ্চ আওয়াজে কথা বলতেন না , নিম্নস্বরে কথা বলা পছন্দ করতেন । কথা বলার সময় তিনি কখনো অট্টহাসি করতেন না, কম আহার করতে ভালবাসতেন। তিনি মুজতাহিবিত দাওয়াত (দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করতেন) ছিলেন। আল্লাহপাকের এবাদত বন্দেগীতে কখনো অলসতা করতে দেখা যায়নি বরঞ্চ দেখা গেছে গভীর রাত পর্যন্ত বিনিদ্রায় যাপন করে আল্লাহ এবাদত করেছেন ,এ রকম অনাড়ম্বর জীবন যাপনকারী পীর মাশায়েখ খুঁেজ পাওয়া বর্তমানে খুবই কঠিন। তিনি সমসাময়িক আলেমদের অনুকরনীয় ব্যক্তি ছিলেন। মুসলিম সমাজকে নৈতিক অবক্ষয় হতে রক্ষা করে আল্লাহ তাঁর রাছুল (সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এর সন্তুষ্টিজনক চরিত্রদ্বারা চরিত্রবান করা যায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাহফিল সেমিনার করে মানুষকে পরিশুদ্ধ করে হেদায়াতের পথ দেখিয়েছেন।মানুষের কল্যানে প্রতিষ্টা করেন প্রতি বুধবার (বাদে এ’শা) সাপ্তাহিক মাহফিল খতমে খাজেগানে রহমানিয়া ,যা অদ্যবিধি প্রচলিত রযেছে। বর্তমানে ও হুজুর কেবলার দরবারে এবং মাহফিলে যারা উপস্থিত হচ্ছেন তারা উপকৃত হচ্ছেন। তিনি ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দ সালে হজ্ব ব্রত পালন করেন এবং ২২শে জিলক্বদ ১৩৮৯ হিজরী ১৯৬৬ খৃষ্টাব্দ রোজ বুধবার বিকাল বেলা অর্থাৎ আছরের সময় ইন্তিকাল করেন ।(ইন্নালিল্লাহে ………রাজেউন) পরের দিন বৃহ¯পতিবার দিনের বেলায় কুতুবে জামান শাহ মুহ্ম্দা জিল্লুররহমান (রহঃ) এর স্বপ্ন অনুযায়ী হুজুর কেবলার দাপন স¤পন্ন করা হয় । হুজুর কেবলার বার্ষিক ওরছ মোবারক ১লা চৈত্র মোতাবেক ১৫ই মার্চ ২০২৩ ইংরেজী বুধবার সারাদিন ব্যপী ধর্মীয় অনুষ্টানাদি তথা খতমে কোরআন, খতমে তাহলিল ,খতমে গাউছিয়া রহমানিয়া,খতমে খাজেগানে রহমানিয়া ও হজুর কেবলার জীবনী আলোচনা পরিশেষে বাদে আছর পীরে ত্বরিকত মাওলানা মুহাম্মদ গোলামুর রহমান আশরফ শাহ্ ম.জি.আ ছাহেব আখেরী মুনাযতের পর তবরুক বিতরণ করা হয়। এতে সকল মুরিদান ও মুহিব্বিনদের সবান্ধবে উপস্থিত হয়ে হুযুর কেবলার রুহানী ফয়েয হাসিল করার আমন্ত্রন জানাচ্ছি।
লেখক – প্রাবন্ধিক ও গবেষক