আমি ও আমার ছেলেরা সাধারনতো কোথাও বের হয়না । ওরা কলেজে যায় কলেজ থেকে সোজা ঘরে ।সব টিচার বাসা তে পড়া তে আসে ।আমি দিনের বেলা মাসে একদিন স্বামীর বেতনের টাকা তুলতে যায় । সন্ধার পর দু ঘণ্টা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে । বাজার আগে করতাম এখন করা লাগেনা দোকানের ছেলেরা ই করে দেয় ।
যাক, বানিজ্য মেলা আমাকে কোনদিন ই টানে না ।ছেলেরা মাঝে মধ্যে আবদার করে কোন বছর যায়, কোন বছর বাদ পরে । বই মেলা সব সময় ই আমায় টানে । বই মেলায় যাওয়ার পথে গাড়ি পায় কিন্ত আসার পথে গাড়ি পাওয়া যায়না । টেলে টুলে বাসে চড়ার অভ্যাস নেই ,তখন খুব কষ্ট হয় । গাড়ি ছিল, গাড়ি ৫ সালে বিক্রি করে দিয়েছি । বাচ্চাদের স্কুল কাছে হওয়াতে আর স্বামী দূরে চাকুরী করে বলে ।এ জন্যে বই মেলাতে কম যাওয়া হয় । ভেবেছি এবার বই মেলাতে যাবো ই যাবো । জানুয়ারি থেকে প্লান করছি মা ছেলে তিন জনে মিলে ।আমি বই কিনবো আর ওরা ঘুরে ঘুরে দেখবে ।
কি শাড়ি পরবো, ঘরে সাজব না পার্লারে সাজবো ।[একবার পার্লারে সেজেছিলাম , আমাকে আমি চিনতে ই পারিনি । ভুত আহা ভুত যাকে বলে । তারপরেও ভাবলাম ভালো পার্লারে সাজবো । নিশ্চয় আমাকে খুব সুন্দরী দেখাবে । সব কবিদের সাথে দেখা করতে যাবো। নুতুন পুরাতন সব ।যারা এফ বি তে দেখেছে তারা আমাকে সুন্দরী ই বলে কেও খারাপ বলিনি ।[ জানিনা গ্যাস দেয় কিনা ] এখন যদি বিশ্রী লাগে কি ভাববে । এবার পার্লারে ই সাজবো ।এক কবি দু মাস ধরে দাওয়াত দিতে লাগলেন ।আমার এতো বড় বড় ছেলে আছে তার বিশ্বাস হয়না ।তার গত বছর দুটো বই বের হয়েছে এবার ও দু টো বই বের হবে ,পঞ্চগড় থেকে অনেক আশা নিয়ে আমাকে দেখতে আসবেন ।তিনি সরকারি কলেজের দর্শনের প্রফেসর ।আমি গাড়ির কথা মনে করে কিছুতেই যাবনা ।আমি বলেছি ,আমাকে দেখার ইচ্ছে থাকলে আমার এলাকায় চলে আসুন ।তিনি নাছোড় বান্দা , বই আমার হতে দিয়ে ছবি তুলবেন । এ দিকে লেখক বড়ভাই এহসান কবির মেলার আসে পাশে ই থাকেন । ভাইয়াকে বললাম, ভাইয়া ১০ তারিখ মেলায় থাকবেন । বাকি যাদের চিনি তাদের মেলায় ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করবো । প্রত্যেকের একটা করে বই সংগ্রহ করবো ।কেননা কারো নাম্বার আমার কাছে নেই । আসলো
আমার প্রিয় দশ তারিখ ।সকাল থেকে রান্না বান্না শেষ করে , খেয়ে দেয়ে রাতের রান্নাও শেষ করে বিকেল ৪ টায় ঘর থেকে শাড়ি পরে দোকানে গেলাম একটু লেনদেনের কাজ শেষ করতে ।তারপর সোজা পার্লারে ।দোকান থেকে ছেলেদের ফোন দিয়ে দিয়ে রেডি হয়ে দোকানে থাকতে বলেছি । পার্লারের মহিলা কে আগেরদিন, দিন ক্ষণ বলে এসেছি ।পার্লারে গেলাম ।গিয়ে দেখি আমাকে যিনি সাজাবেন তিনি নেই ।আধ ঘণ্টা বসে বসে ফোন করতে ই লাগলাম কিন্ত কারো ফোন তিনি ধরছেন না ।বাসায় যেতে পারছিনা ছেলেদের কাছে চাবি । দোকানে গেলে বড় ছেলে আর মেলায় ই যাবেনা ।প্রাই এক ঘণ্টা পর তিনি এলেন । এদিকে বড় ছেলে রেগে আগুন ।বলল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে না গেলে সে সোজা বাসায় চলে যাবে ।
আমি বাবা সোনা বলে আরও পাঁচ মিনিট টাইম নিলাম ।এদিকে মহারানী ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে, আটা, সুজি , ময়দা মেখে ই যাচ্ছেন ।আমি যতই বলি আমাকে বেশী সাজাবেন তিনি ততই গর্বের সহিত তা করে ই যাচ্ছেন ।
এদিকে ছেলের ফোন ।কোন রকমে সেজে আয়নায় আর তাকালাম না সোজা সি. এন. জি র কাছে ।ওকে আগে ই রিজার্ভ করে রেখেছিলাম ।
আমরা সন্ধ্যা ছয় টায় রওয়ানা দিলাম ।বিজয় সরণী পর্যন্ত যেতে পেরেছি তার পর থেকে বসা, গাড়ি আর এগুয়না এতো ট্রাফিক জ্যাম ।মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে লাগলাম ।কারণ আমি কাউকে কথা দিলে, কথা রাখতে চেষ্টা করি । কবি বেটা ফোন করে ই যাচ্ছেন । কবির ভাই বুঝতে পেরেছেন কারণ তিনি ঢাকায় থাকেন । কবির ভাই বললেন, রিনি তুমি যতক্ষণ না আসো আমি থাকবো ।কবির আবার ট্রেন ধরতে হবে ।তাই তার তাড়া । রাত সারে আটটা গিয়ে পৌঁছলাম । পঞ্চগড়ের কবির সাথে সাক্ষাত করে নিলাম ।তাঁকে বিদায় জানালাম ।দু চার টে স্টল ঘুরতে ই আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো দোকান ।কবির ভাইয়া আমারদের সবাই কে পেট পুড়ে গরম গরম খাওয়ালেন গরম দাম দিয়ে ।[ গলা কাঁটা দাম ]
অন্ধকারে কিছু ছবি নিলেন । তারপর আমরা বিদায় নিলাম ।বাইরে আসে দেখি, সি এন জি বেটার খবর নেই । ভাড়া তখন নেইনি ।হয়তো ভালো খেপ মেরেছে ।এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন গাড়ি খুজ লাম পেলাম না। বড় ছেলে বলল চলো সামনে যাই । এ ভাবে এগুতে এগুতে বাংলা মটরে এসেছি ।কিছু দূর গিয়ে চা খেয়েনিলাম ।গাড়ি পাচ্ছিনা , হেঁটে হেঁটে একেবারে ফার্মগেট । ওখানে আসার পর চার টা খালি বাস পেলাম পরে দেখি একটা এ.সি বাস । ওঠে গেলাম । দেখলাম বেশ টিপটপ ।আরামে বসে চোখ বন্ধ করে বসে আছি । গাড়ি না ভরলে তো গাড়ি ছাড়বেনা ।মহা বিরুক্তি লাগছে । আমি চোখ খুলে তাকাতে ই দেখি শ্যাম বর্ণের, এক সুঠাম দেহী দীর্ঘ পুরুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমি তাকিয়ে রইলাম বোকার মতো , যেন বিস্ময়ে হতবাক ।বেচারি লজ্জা পেয়ে বসে গেলেন । আমি মনে মনে ভাবছি কেন চোখ খুলতে গেলাম ।পার্লারে সেজেছি একটু প্রান ভরে দেখত ।পার্লারের সাজের টাকাটা তো উসুল হতো । গাড়ি ছাড়ল ।গাড়ি থেমে আছে ।জ্যাম দ্রুত শেষ হয়ে গেলো, মনে মনে ভাবলাম জ্যাম আরেকটু থাকলে ক্ষতি কি ছিল । নাহ তখন আর জ্যাম নেই । নামার সময় তিনি মুচকি হাসলেন আমি একবার তাকালাম , তারপর নেমে পড়লাম ।ঘরে ফিরলাম এই আবেশ টুকু নিয়ে, মনে মনে ভাবলাম মেলায় যাওয়া আমার সার্থক হয়েছে ।এক গাদা টাকার উসুল ওঠছে কেও না কেও তো দেখেছে মন ভরে ।এখন জুতা খুলে পা মাটিতে ফেলতে পারছিনা ।পায়ের তলায় ফোস্কা পড়েছে মনে মনে ভাবলাম, একটু ফোস্কা ই তো পড়েছে । সি. এন. জি পেলে তো, ওঁই ভদ্র লোক আমাকে দেখতে পেতেন না । ।কষ্ট করে হেঁটে আয়নার সামনে গেলাম । আমি তো আমাকে ই চিনতে পারছিনা ।[একেবারে বোবা ভুত হয়ে গেলাম, কেমন বিশ্রী লাগছে বুঝান মুশকিল ।এঁকে বারে সঙ ]
ছেলেদের জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে বলতো । বড় ছেলে কাঁচ ভাঙা হাসিতে ফেটে পড়লো ।আম্মু তুমি যখন সেজে বের হয়েছিলে তখন ই তোমাকে বলতাম কিন্ত তোমার মন খারাপ হবে নয়তো আমাদের মেলায় যাওয়া বন্ধ হবে তাই বলিনি । দোকানের ম্যানাজার কে ফোন দিলাম সে বলল, সি.এন. জি ওয়ালা নাকি বলেছে আপনার মেদাম কে পার্লারের আগে কি সুন্দর লাগলো পারলার থেকে বের হউয়ার পর দেখি,
তাঁকে করুন অবস্থা দেখাল ।
ছোট ছেলে বললে যা হবার হয়ে গেছে ।মনে মনে ভাবলাম, মেলার লোক গুলো যে তাকাল, বাসের সেই লোক তার মানে, বাথ রুমে ঢুকে মুখ ঘষে ধুয়ে পার্লারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে রান্না ঘরে দিলাম দৌড় ……!!!
বই……..মেলা নিয়ে মেলা কথা ।…………………শাহ সাবরিনা মোয়াজ্জ।
