চট্টগ্রাম নগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহিত প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরুর প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো আতুড় ঘরেই পড়ে রয়েছে। নগরীর কয়েকটি এলাকায় খাল খনন কাজ শুরু হলেও তা আশাব্যঞ্জক নয়। অন্যদিকে এতদিন জলাবদ্ধতা সমস্যার অন্যতম কারণ নালা–নর্দমা পরিস্কার, সংস্কার কাজে প্রতি বছর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করত। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ছোট ড্রেন অর্থাৎ তিন ফুটের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট ড্রেনগুলোর সংস্কার বা উন্নয়ন কাজ অন্তর্ভুক্ত থাকায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও একাজ থেকে বিরত রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বর্ষা মৌসুমে নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এই শঙ্কায় শঙ্কিত চট্টগ্রাম নগরের ৬৫ লাখ জনসাধারণ। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের গৃহীত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের শম্ভুক গতি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জনঅনাস্থা। তারা এখন জনপ্রতিনিধিদের কাছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছে। নগরীর ৪১ ওয়ার্ড কাউন্সিলররা সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের কাছে জনগণের এই প্রশ্নের উত্তর দাবী করেছেন।
আজ চসিক কেবি আবদুচ ছাত্তার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত চসিকের ৪৩ তম সাধারণ সভায় জলাবদ্ধতা নিরসন ইস্যু নিয়ে কাউন্সিলররা তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন বলে জানা গেছে। তারা প্রকল্পের ধীরগতি নিরসন ও আগামী বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা সমস্যায় করনীয় নির্ধারণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রত্যক্ষ ভূমিকার দাবী উপস্থাপন করেছেন
নির্ভরশীল সূত্রে জানা যায়, সভা শুরুর এক পর্যায়ে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নিয়ে প্রথমে প্রশ্ন উত্থাপন করেন ২৫ নং রামপুর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এরশাদ উল্লাহ। তিনি বলেন, আমার রামপুর ওয়ার্ড এলাকায় তিনটি খাল রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ শুরুর কথা থাকলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু প্রাথমিক কাজ শুরুর কারণে খালের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে এখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ আমাকে দোষারোপ করছে। এমতাবস্থায় একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়র মহোদয়ের কাছে আমার করণীয় জানতে চাই।
জবাবে মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পটি নিয়েছে। তবে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই প্রকল্পের পরিচালনা আবার চউকের হাতে। অথচ চউক এব্যাপারে দায়সারা ভূমিকায় রয়েছে। এই প্রকল্পের যে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা আদৌ হয়নি। তিন ফুটের উপরে ড্রেন পরিস্কার বা সংস্কারে প্রকল্পে শর্ত যুক্ত থাকায় সিটি কর্পোরেশনও একাজ করতে পারছেনা। মন্ত্রণালয়ের গত সভাতে এ বিষয়ে আমি প্রস্তাব তুলেছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মহোদয় সমন্বয় করে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া আমাদের দুই জন কাউন্সিলর সিডিএ‘র বোর্ড মেম্বার। তাদেরকেও জনপ্রতিনিধির অবস্থান থেকে বিষয়টি নিয়ে বোর্ড সভায় কথা বলার জন্য ইতোপূর্বে নির্দেশনা দিয়েছি।
তিনি প্রত্যেক কাউন্সিলরকেস্ব স্ব ওয়ার্ডে এই প্রকল্পের অগ্রগতি এবং ধীরগতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সৃষ্ট সমস্যার সঠিক তথ্যচিত্র আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পের নানামুখী সমস্যা সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ত্রিপক্ষীয় সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।একই সাথে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে জনগণকে জানিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছি।
এ প্রসঙ্গে বাগমনিরাম ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিডিএ‘র বোর্ড মেম্বার গিয়াস উদ্দিন বলেন, মেয়র মহোদয়ের পরামর্শ অনুযায়ী গত ১০ দিন আগে অনুষ্ঠিত সিডিএ‘র বোর্ড মিটিংয়ে আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে প্রশ্ন করেছি। বলেছি আপনি প্রকল্প নিয়েছেন। এর জবাবদিহিতা আপনাকেই করতে হবে। জনগণের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদেরকে। আমি তাকে প্রেস কনফারেন্স করার কথাও বললাম। আর উনি বললেন এটা সেনাবাহিনীর দায়িত্ব। অথচ এই প্রকল্পের পরিচালক সিডিএ প্রকৌশলী। আমার এলাকায় খাল খননের বিষয় নিয়ে প্রকল্প পরিচালককে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেন না।অথচ আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা নিয়ে শঙ্কিত জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত আমাকে প্রশ্ন করছে। কিন্তু আমি কোন সদুত্তর দিতে পারছি না।জনগণকে নিয়ে আমরা রাজপথে নামব।
এ ব্যাপারে সিডিএ‘র অারেক বোর্ড মেম্বার ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, মেয়র মহোদয়ের নির্দেশ মতো বোর্ড সভায় আমি এই ব্যাপারে কথা বলেছি। অপরাপর বোর্ড মেম্বাররাও এতে সমর্থন জানান। ৩৬টি খাল ভরাট,দখল নিয়ে আমার সাথে অপরাপর বোর্ড মেম্বাররাও আপত্তি তুলেন। প্রকল্পের ধীরগতি নিয়ে জনগণের কাছে আমাদের জবাবদিহিতার বিষয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে জানাই। তিনি সেনাবাহিনীর দায় দিচ্ছেন। প্রকল্পের টাকা ছাড়ের আবেদনের জন্য বিশেষ সভা ডেকে অনুমোদন নিয়ে নেন। কোন পূর্ব পরিকল্পনা থাকে না। এদিকে বাস্তবে প্রকল্পের কোন অগ্রগতিই চোখে দেখা যাচ্ছে না। বর্ষা চলে আসবে। এবার জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি নিয়ে হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের আগে ফিজিবিলিটি স্টাডির নিয়ম থাকলেও এই প্রকল্পে তা করা হয়নি। যতদূর জানি এই প্রকল্প পাস হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে। তাও সরেজমিনে নয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্লোবাল ম্যাপ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলীও তার সাথে সুর মেলান। তিনি বলেন, আমার এলাকায় নয়া মির্জা খালের খনন কাজ করার জন্য সেনাবাহিনী ব্রিজ ভাঙ্গবে। উনারা আমার কাছে এই খালের বিস্তারিত জানতে চান। কিন্তু আমি বলতে পারিনি। আমি তো আর এই খালের ফিজিবিলিটি স্টাডি করিনি। আজ পর্যন্ত ত্রিপুরা খালের এক ইঞ্চি মাটিও তোলা হয়নি। কোন স্কেভেটিং কাজ হয়নি। চান্দগাঁও ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, আগামী বর্ষায় আমাদেরকে এলাকা ছেড়ে যেতে হবে। সিডিএ না পারলে দোষ স্বীকার করা উচিত।