প্রথম দিন মেলার অভিজ্ঞতা আমাকে খুব যন্ত্রণা দিয়েছিল ।এতো সেজে ও [পার্লারে ] আমি দু দিন হতাশায় ঘুমাতে পারিনি । যৌবন বয়সে মনে ফাগুন আসেনি । রঙিন শাড়ি পড়েনি ।কানে ফুল গুজিনি । বসন্ত বরন উৎসবে মাতিনি । প্রেমিকেকের হাত ধরে রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয়নি ।এক রিক্সায় বসে বাহু বন্দি হয়নি । সেই আমি কিনা চল্লিশে এসে পার্লারে সাজতে গেলাম । ছেলেদের বার বার জিজ্ঞেস করি কেমন লেগেছে, ওঁরা হাসে আর বলে খুব খুব ভালো লেগেছে । আমি জানি ভারি মেকআপ কি রকম লাগে । আগে শুটিং করেছি গানের সাথে তখন আমায় ভুত লাগ তো কিন্ত স্ক্রিনে খুব ভালো আসতো ।
বই মেলার ছবি ভালো এসেছে কিনা জানিনা কারণ ততোক্ষণে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো ।
যাক প্রথম দু দিন মনটা খারাপ ছিল , কারো সাথে দেখা হলনা, একটু ঘুরে দেখতে পারিনি দ্বিতীয়ত সাজ নিয়ে মন টা বেশ খারাপ ছিল । বই মেলার আগে স্বামীর গ্রামের এক ভদ্র লোকের সাথে পরিচয় । তাঁর নাম ধাম পরিচিতি নাইবা বললাম । পদস্থ অফিসার ।স্বামীর সাথে ই এস এস সি পাস করা । তাঁর সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় । আমার দোকানে আসে । তাঁর বাসা থেকে আমার বাসা পাঁচ মিনিটের হাটা পথ । কিন্ত কেও কারো বাসায় যাওয়া হয়নি । স্বামীর সাথেও কথা হয় তাঁর । দেখলাম লোকটা খুব মিশুক ।কিন্ত পরের হাড়ির খবর নিতে ওস্তাদ । সে আমার পাশের জেলায় বিয়ে করেছে । জেলা দু তো হলেও দূরত্ব খুব ই কাছের ।
আমাকে ভাবি বলে ডাকে । আমি আরেক দিন মেলায় যাবো কিন্ত গাড়ি না পাওয়ার ভয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিই । সে লোকটি বলে ভাবি আমার সাথে যাবেন ।আমার গাড়ি আছে । স্বামী কে বললাম, স্বামী বলে যেও । বড় ছেলে কে বললাম, চলো, তাঁর আবার নাক উঁচু , পরের গাড়িতে যাবেনা । ছোট ছেলে কে বললাম সে বলল, আমার পরিক্ষা, যাওয়ার প্রশ্ন ই আসেনা ।
আমি পড়লাম বিপদে । কথা দিয়ে কথা তো আর ফিরিয়ে নিতে পারিনা । যেদিন যাবো, আগের রাতে মেয়ে এসেছে ,তাঁর সাথে গল্প করতে করতে বললাম তুমি চলো, সে বলল তোমাদের সাথে আমি যাবনা, বান্ধবীদের সাথে যাবো । মেয়ের সাথে কথা বলে রাত বেজেছে তিনটা । ভোর পাঁচ টায় ভাশুর এসেছে যশোর থেঠে, সেই যে ওঠছি আর ঘুমায়নি ।সবার সব কাজ শেষ করে রাতের রান্না শেষ করেছি ।এবার আলমারির কাছে এলাম শাড়ি পড়বো । ওমা দেখি ব্লাউজ সব ছোট হয়ে গেছে আর আমি বড় হয়ে গেছি । অনেক বছর শাড়ি পড়া হয়না তাই বুঝিনি কখন আমি হাতির রূপ ধারন করিছি ।যাক, মন পড়ে আছে বই মেলায় ।কোন রকমে সেজে গুঁজে বই মেলার উদ্দেশে ঘর থেকে বের হলাম ।পাঁচটায় গাড়িতে ওঠেছি , দেখি ড্রাইভার নেই তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে যাবেন । ভদ্রতার খাতিরে তাঁর সামনের সীটে বসেছি ।
তিনি বললেন, জানেন আমি খুব স্মার্ট, সেদিন তো আপনারা জ্যামে পড়েছেন আজ দেখবেন সাঁই সাঁই করে কোথা দিয়ে যাবো আপনি বুঝতেই পারবেন না । এদিক দিয়ে ঢুকবো ওঁই পথে যাবো তারপর ওঁই পথে তারপর নানা বর্ণনা দিতে দিতে অস্থির । আমি চব্বিশ ঘণ্টায় ঘুমিয়েছি এক ঘণ্টা ।
আসার সময় মাথা ব্যথা করছিল ওষুধ খেয়েছি, প্রেশারের ওষুধ খেয়ে তবে ই ঘর থেকে রওয়ানা দিয়েছি । ঘুমের ভাব নেই কিন্ত কোন কিছু শুনার বলার ইচ্ছে নেই । লোকটা সকল ধরনের ইতিহাস বলতে ই লাগলো । শালার বাচ্চা হয়না , শাশুরির অমুক, বউয়ে তমুক তাঁর জীবনীর সাতকাহন আমাকে শুনিয়ে ই যাচ্ছে । একদিকে জ্যাম অন্যদিকে তিনি লাউড স্পীকারে কথা জোরে জোরে বলে যাচ্ছেন । এক মিনিটের কথা দশ মিনিট ধরে । আমি মহান আল্লাহ কে ডাকতে লাগলাম,” হে প্রভু, এই লোকটার কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করো ।” লোকটার অত্যাচার সয়ে বার বার হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বিরক্তির হাসি দিতে লাগলাম । লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে
আমি তাঁকে বললাম আমার খুব খারাপ লাগছে, আপনি একটু চুপ করুন । দুই/তিন মিনিট চুপ । তারপর আবার শুরু ।বক বক করতে ই লাগলো দিগুণ উৎসাহ নিয়ে । আর ফোন জোরে জোরে কথা বলতে ই লাগলেন । এভাবে যাওয়ার পথে টানা তিন ঘণ্টা । মনে মনে ভাবলাম কোন পাপের ফল ভোগ করছি, আল্লাহ ভালো জানেন । যাক রাত সারে আঁটটা পৌঁছলাম মেলায় ।
সানিয়া কে ফোন দিলাম ও চলে গিয়েছিলো, আমি এসেছি শুনে সে আবার সে ফেরত আসছে এই সময়ের মধ্যে লোকটি সানিয়ার একটি বই নিয়ে ওর লেখক পরিচিতি পড়ে ফেলেছে, সানিয়া এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল । এরি মাঝে লোকটা সানিয়াকে তাঁর লেখক পরিচিতি পড়ে যা যা জানল সব ওকে বলে অবাক করে দিতে লাগলো । সানিয়া আমাকে বলল, তুমি বলেছ ,আমি বললাম, না । কারণ সানিয়া আমার এলাকার মেয়ে হলেও আমি তাঁর বিস্তারিত জানিনা । সানিয়ার সাথে কথা বলে ছবি তুলতে তুলতে রাত নয়টা বেজে গেলো ।
আমরা বের হচ্ছি সে বেটা সাংবাদিকের মতো দৌড়ে দৌড়ে আমাদের ছবি নিতে লাগলো । যাক ,এবার আসার পালা ।মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলাম । আবার বক বক শুরু, বললাম গাড়ি থামান আমি নেমে হেঁটে যাবো । এবার আমার রেসপন্স না পেয়ে, শিষ বাজাচ্ছে, হাতে তুড়ি দিচ্ছে, গান গাচ্ছে , কখনো বলছে, ডাইনে কাইটটা বায়ে যা, বাইয়ে কাইটটা ডাইনে যা । জ্যাম পড়লে, অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করছে, আর বলছে, যা বেটা যা, আরে জানা । জ্যাম ছেড়ে দিলে হিজড়াদের মতো তালি বাজাচ্ছে ।যাক এ ভাবে কিছু দূর আসার পর ভিভি আই পি যাবে ওখানে প্রায় এক ঘণ্টা জ্যামে ।
এখন লাফাচ্ছে মানে নাচ্ছে আর হেঁড়ে গলায় গান গাচ্ছে । যাক কোন রকমে আসলাম, গাড়ি থেকে নামার পর ফিরেও তাকায়নি । ভালো করে বেটা কে, আগে ই দেখেনি । এতো হালকা লোক কি করে অফিসার হয় , এদের কে কারা অফিসার বানায় ।বেশী কথা বললেই ,মানুষ স্মার্ট হয় । নাকি তিনি আমাকে বুঝতে চেয়েছেন এই পঞ্চাশ বছরেও তিনি তরুন ।
ছয় ঘণ্টা আমার জীবনে যে অভিজ্ঞতা হল টা সারা জীবন মনে থাকবে ।
মনে ভাবলাম, এই ছয় ঘণ্টা আমার লেখক বন্ধুদের সাথে যদি কাটাতাম, তবে অন্তত কিছু দিন আয়ু আমার বাড়তো । কিছু সময় আনন্দ নিয়ে বাঁচতাম ।
বই…………………মেলা নিয়ে মেলা কথা [পর্ব… ২ ] শাহ সাবরিনা মোয়াজ্জেম।
![বই.....................মেলা নিয়ে মেলা কথা [পর্ব... ২ ] শাহ সাবরিনা মোয়াজ্জেম।](https://reeabangla.com/wp-content/uploads/2019/02/52093991_764037610647225_7565377303249682432_n.jpg)