ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সর্বোচ্চ মামলা ও গ্রেফতারের বিষয়কে ভালোভাবে নিতে পারছেন না ব্যাংকের এমডিরা। সোমবার দুদক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদের দেওয়া এক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর এমডিরা বলছেন, অপরাধ না করেও ব্যাংকের অনেক এমডি ভয়ে আছেন। কেউ কেউ বলেছেন, নিরাপরাধ কর্মকর্তারাও গ্রেফতার হচ্ছেন। হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা এমনও বলছেন, যেভাবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ধরা হচ্ছে, তাতে আমরা স্পৃহা হারিয়ে ফেলছি। আমরা আগ্রহ হারাচ্ছি।
প্রসঙ্গত, সোমবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে ‘কৌশলপত্র-২০১৯’ নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, কমপক্ষে ১২০ জন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি, জিএমসহ উচ্চপদের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন, এখন এমন একটি পরিস্থিতিতে আছি, অপরাধ না করেও ব্যাংকের অনেক এমডি ভয়ে আছেন। কথা বললেই হয়তো ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের কথা অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান বলবেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের কর্মকর্তাদের নিয়ে দুদক চেয়ারম্যানের এভাবে কথা বলা ঠিক নয়। কারণ, ব্যাংক কর্মকর্তারা কাজ করছেন দেশের উন্নতির জন্য। দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই ব্যাংক কর্মকর্তারা দিনরাত কাজ করছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক একজন চেয়ারম্যান বলেন, যে কর্মকর্তা অপরাধী তাকে অবশ্যই ধরা উচিত। তবে যেভাবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ধরা হচ্ছে, সেটা ব্যাংক খাতের জন্য খারাপ সংবাদ। এভাবে ধরা হলে ভবিষ্যতে কেউ ব্যাংক কর্মকর্তা হতে চাইবেন না। তিনি উল্লেখ করেন, আমরা স্পৃহা হারিয়ে ফেলছি। আমরা আগ্রহ হারাচ্ছি। আমরা সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করার পর যখন এই ধরনের কমেন্টস শুনি, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দুদক যাদের ধরছে ধরুক। কিন্তু কোনও নিরাপরাধ কর্মকর্তা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকটাও দেখতে হবে। আমরা দেখেছি, অনেক নিরাপরাধ কর্মকর্তাও গ্রেফতার হচ্ছেন, হয়রানির শিকার হচ্ছেন, শাস্তি পাচ্ছেন। এতে একদিকে আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে নতুনরা আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এর ফলে নিকট ভবিষ্যতে পুরো ব্যাংকিং খাতে দক্ষ কর্মকর্তার অভাব তৈরি হবে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘ব্যাংকিং খাতের কর্মকর্তাদের ধরা সবচেয়ে সুবিধার। এদেরকে সবচেয়ে সহজে ধরা যায়। কারণ, এদের কেউ অন্য সেক্টরের মতো পালিয়ে থাকে না।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক খাতে দুর্নীতি হচ্ছে না এ কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু সবাই তো খারাপ না। মুষ্টিমেয় কিছু কর্মকর্তা আছে খারাপ। কিন্তু যখন দেখি অনেক নিরাপরাধ কর্মকর্তা শাস্তি পাচ্ছেন তখন খারাপ লাগে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘শীর্ষ পদে যারা থাকেন, তারা অনেক সময় বিভিন্ন ফাইলে বিশ্বাসের ওপরও সই করেন। আমরা যদি প্রত্যেকটা লাইন পড়ে পড়ে স্বাক্ষর করতে যাই তাহলে ব্যাংকের কার্যক্রম স্লো হয়ে যাবে (গতি কমে যাবে)। যদিও ব্যাংকাররা এখন আর আগের মতো কাগজে সই করেন না। ফলে অনেক ভালো গ্রাহকও ঋণ পাচ্ছে না।’
এবিবি’র চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বেশিরভাগ লোকই নির্দোষ। আমরা এমন দেখেছি, কোনও একটি লোনে ডিফল্ট করেছে কোনও একটি লোক। যখন সেই লোকটাকে ধরা যাচ্ছে না, তখন ব্যাংক কর্মকর্তাকে ধরা হচ্ছে। সে হয়ত আসলেই নির্দোষ। তার মতে, যে সব কর্মকর্তা সত্যিকারভাবে দোষী তাদেরকে ধরা উচিত। শুধু ব্যাংকারদের ওপর দোষ চাপালে হবে না।’
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারপ্রেস নেটওয়ার্কের (আইপিএন) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না। বিশেষ করে ব্যাংকের কোনও না কোনও কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কারণেই নাম সর্বস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রে ভালো গ্রাহক ঋণ পায় না, অথচ কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার ফলে নাম সর্বস্ব শত শত কাগুজে প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক এখন সবচেয়ে সমস্যায় রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ৭৭টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একইভাবে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক থেকে একশ’র বেশি বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের কারণেই শুধু নয়, কিছু ঋণগ্রহণকারীর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি তৈরি করছে। কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার অনিয়মকারীদের যোগসাজস এবং প্রভাবশালী খেলাপিদের কারণে পুরো অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সোমবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ১৮তম নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচার ‘ইথিকস ইন ব্যাংকিং’ অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন।