পুলিশ অফিসার, মোহাম্মদ মোহসীন-
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পাশের নগরী হিমস। এই নগরে যাকেই গভর্নর করা হউক না কেন, নাগরিকদের অভিযোগের অন্ত থাকে না! কিছুদিনের মধ্যেই খলিফার কাছে তারা আবেদন জানায়ঃ এই লোকের চেয়ে ভালো একজন গভর্নর নিয়োগ দিন!
বিরক্ত খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) হন্যে হয়ে একজন যোগ্য গভর্নর খুজঁতে শুরু করলেন। কে আছে এমন ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতেই পারে না?
উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) নিয়োগ পেলেন হিমস নগরীর গভর্নর পদে। তখন তিনি শাম দেশে নিয়োজিত ছিলেন জিহাদের সেনাপতি হিসেবে। তিনি ছিলেন মহানবী (সাঃ) এর স্নেহধন্য একজন সাহাবী। আদেশ পেয়েই ছুটলেন নতুন কর্মস্থলে…
এক বছর হয়ে গেলো এর মধ্যে হিমস থেকে কোন অভিযোগ এলো না! গভর্নর কোন চিঠিও লিখলেন না খলিফাকে আবার কোন রাজস্বও এলো না!
আশ্চর্যান্বিত খলিফা জরুরী পত্র দিয়ে ডেকে পাঠালেন গভর্নর উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) কে।
পত্র পাওয়া মাত্র তৈরী হয়ে গেলেন! নিত্য ব্যবহারের ব্যাগে ওজুর পাত্র আর খাবারের প্লেট ঢুকিয়ে হাঁটা শুরু করেন মদিনার দিকে।
ইতিমধ্যে চুল দাড়ি বড় হয়ে গেলো মদিনায় পৌঁছাতে গিয়ে! অবিরাম পথ চলায় ক্লান্ত শ্রান্ত এই বিধ্বস্ত গভর্নর কে দেখে খলিফা তাকে বসতে দিয়ে জানতে চাইলেনঃ
: এই অবস্থা কেন তোমার?
: কই আমার তো কিছুই হয় নি। আমি বেশ আছি। বরং সাথে নিয়ে এসেছি আমার গোটা দুনিয়া।
: কি আছে তোমার দুনিয়ায়?
: আমার ব্যাগে আছে পানি পান ও ওজু করার জন্য পাত্র, গোসলের বালতি, খাবার প্লেট আর পানির মশক। এটাই আমার দুনিয়া। এই কটা দ্রব্য ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।
: তুমি কি হেঁটে এসেছো?
: জ্বী, আমিরুল মোমেনিন।
: প্রশাসনের পক্ষ থেকে কি তোমাকে ঘোড়া দেয়া হয়নি?
: বর্তমান প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি আর আমিও চাই নি।
: বাইতুল মালের রাজস্ব পাঠাওনি কেন?
: যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে কর নিয়ে আসতো, তাদের সাথে কথা বলে সেই অঞ্চলের অভাব অভিযোগ এবং অতি দরিদ্রদের তালিকা করে সেখানেই তাদের সাহায্য ও অঞ্চলসমূহের উন্নয়ননের জন্য খরচ করেছি। রাজধানীতে পাঠানোর মতো অবশিষ্ট থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দিতাম।
স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্বের যথাযথ ব্যবহারের নতুন পদ্ধতি জেনে খলিফা ভীষণ খুশি হলেন এবং তাকে পুনরায় স্বপদে যোগ দিতে বললেন। কিন্ত উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) বিনয়ের সাথে গভর্নর পদ ফিরিয়ে দিয়ে মদিনা উপকন্ঠে নিজের পরিবারের সাথে বসবাস করতে চাইলেন। খলিফা সেই আবেদন মঞ্জুর করলেন।
খলিফা ওমর ফারুক (রাঃ) কিছুদিন পর উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) এর প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত একজন গোয়েন্দা হারেস কে পাঠালেন। ১০০ দিনারের একটি থলে দিয়ে বললেনঃ যদি তার আর্থিক অবস্থা সত্যিই শোচনীয় হয় তবে নিজের পরিচয় জানিয়ে আমার সালাম দিয়ে এই থলেটি তাকে উপহার দিয়ে এসো।
খলিফার গোয়েন্দা স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে একদিন পৌঁছে গেলেন উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) এর দরোজায়। পরিচয় গোপন করে মুসাফির হয়ে তার আতিথ্য প্রার্থনা করলেন। উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) ছদ্মবেশী গোয়েন্দাকে সাদরে বরণ করে নিলেন আর তিন দিন রাতে খেতে দিলেন শুধু একটি করে পাতলা যবের রুটি!
চতুর্থ দিন একজন প্রতিবেশী সেই গোয়েন্দা হারেস কে নিজের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। হারেস কৌতুহলের বশে জানতে চাইলে বললেনঃ আপনার উপস্থিতিতে উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) ভীষণ বিপদে পড়ে গেছেন। আপনাকে আপ্যায়ন করতে গিয়ে উনি সস্ত্রীক গত তিনদিন শুধু পানি খেয়ে আছেন, তা না হলে তারা প্রতি রাতে একটি পাতলা যবের রুটি ভাগ করে খেতেন…
গোয়েন্দা হারেস অবশেষে নিজের পরিচয় জানিয়ে খলিফা ওমর (রাঃ)’র পক্ষ থেকে সালাম সহ সেই থলে তার হাতে তুলে দিলেন। উমাইর ইবনে সাদ রাঃ বিনয়ের সাথে সেই উপহার ফিরিয়ে দিতে চাইলে সব শুনে ভেতর থেকে উনার স্ত্রী বললেনঃ উপহার ফিরিয়ে দিবেন না। বরং এই অঞ্চলে যারা দরিদ্র তাদের মধ্যে ভাগ করে দিন। স্বামী স্ত্রী দুই চোখ এক করলেন না সেই অর্থ বিতরণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
গোয়েন্দা হারেস খলিফার কাছে তুলে ধরলেন তার অভিজ্ঞতা। খলিফা আবার ডেকে পাঠালেন উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) কে। তিনিও কালবিলম্ব না করে ছুটলেন খলিফার দরবারে…
খলিফা তাকে কাছে বসিয়ে জানতে চাইলেনঃ
: আমার পাঠানো দিনারগুলো দিয়ে কি করেছো?
: মুদ্রাগুলো যখন আমাকে দিয়েই দিয়েছেন, তখন আর জেনে কি হবে?
: আমি অনুরোধ করছি, বলো কি করেছো?
: নিজের (সম্ভবত আখেরাত বোঝাতে চেয়েছেন) জন্য সঞ্চয় করে রেখেছি, যেদিন সন্তান ও সম্পদ কোন কাজে আসবে না…
হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) কাঁদতে কাঁদতে বললেনঃ আমি ঘোষণা দিচ্ছি যে তুমি সেইসকল মহান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত, যারা নিজেরা অভাবী হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
তিনি উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) কে ৬০ সা (এক সা হলো তিন কেজি তিনশত গ্রাম) খাবার আর এক জোড়া পোশাক উপহার দিলেন।
উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ) খাবার ফিরিয়ে দিলেন প্রয়োজন নেই জানিয়ে! তবে একটি পোশাক গ্রহণ করলেন এই বলেঃ আমার স্ত্রীর জন্য নিচ্ছি, কারণ তার পোশাক ছিঁড়ে বিবস্ত্র প্রায়।।
প্রফেসর সেলিম উদ্দীন-
মাহে রামাদ্বানে তারাবিহ সালাত আদায় নিয়ে আমরা সবাই কমবেশি স্পর্শকাতর। ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত নামাজ না পড়া ব্যক্তিও তারাবিহ পড়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে পড়েন। আমি বলবো অবশ্যই ভাল দিক। কিন্তু ফরজ নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন না করে শুধু নফল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া বরং একধরণের রিয়ার শামিল।
নফলের ফজিলত অবশ্যই আছে তবে তা ফরজ আদায়ের পর। ফরজ আদায় ব্যতীত শুধু নফল নিয়ে ব্যস্ত থেকে লাভবান হবার সম্ভাবনা নেই। কোরানে বারবার আক্বিমূস সালাত বলতে যা বুঝানো হয়েছে তা মূলত ফরজ নামাজকেই বুঝানো হয়েছে। ফরজ নামাজ পড়তে অভ্যস্ত ব্যক্তি নফলও আদায় করা সহজ হয়ে যায়।
আরেক শ্রেণির মানু্ষ আছে রামাদ্বানে খতম তারাবী পড়া নিয়েও তোড়জোড় শুরু করে দেন। মাহে রামাদ্বানের তারাবিহ নামাজে পুরো কোরআন খতম দেয়া হয় তা নিঃসন্দেহে উত্তম সওয়াবের কাজ।এতে অধিক সওয়াবের আশা করা যায়। এছাড়া আল্লাহর কালাম শুনা এটাও সুন্নত।
প্রশ্নটা অন্যখানে। আমাদের দেশে খতম তারাবীর নামে যা হয় তাতে সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের পাল্লা ভারী হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়।
প্রথমতঃ রামাদ্বানের তারাবিহকে কেন্দ্র করে প্রতি মসজিদে খতম তারাবিহ এর আয়োজন করা হয়। এতে সম্মানিত হাফেজদের তারাবিহ পড়ানোর জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। এ হাফেজ নিয়োগে চলে রমরমা ব্যবসা। হাফেজদের সাথে দর কষাকষি চলে পারিশ্রমিক নিয়ে।অথচ ইসলাম কোরান পড়িয়ে পারিশ্রমিক নেয়া সমর্থন করে না। তাহলে প্রসঙ্গত উঠে আসে হাফেজদের সম্মানী নিয়ে। এ ক্ষেত্রে কোন পক্ষই ছাড় দিতে রাজী নয়।মসজিদ কতৃপক্ষ এই খতম তারাবীহ উপলক্ষে মুসল্লীদের পক্ষথেকে চাঁদা নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা ফেদে বসেন এমন অভিযোগ প্রায়শ শুনা যায়।ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যাবে ন।
দ্বিতীয়তঃ সম্মানিত হাফেজরাও নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের সুরাহা ছাড়া আল্লাহর ওয়াস্তে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে খতম তারাবিহ পড়াতে রাজী হন না। বেশির ভাগ হাফেজরাই এটাকে রোজগারের অন্যতম মোক্ষম সুযোগ মনে করেন।হাদিয়া হিসেবে যা দেয়া হবে তাতে উনারা রাজী নন।
তৃতীয়তঃ প্রায় প্রত্যেকটা মসজিদে কমপক্ষে দুইজন কিংবা কোথাও কোথাও তিনজন হাফেজকে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে। যে কোনভাবেই হোক না কেন হাফেজরা একে অপরের পূর্ব পরিচিত কিংবা পূর্ব পরিচিত না হলেও স্বল্প সময়ে পরিচিত হয়ে যান। উনাদের মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত একটা আতাত হয়েই যায়। কেউ কারো ভুল ধরেন না। আমমুসল্লিরা সেটা টের পাবার সাধ্য আছে কি? আবার ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়। একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত কিংবা আদর্শিক কোন বৈরিতার কারণে পরস্পরের ত্রুটি খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এমনকি এর জের ধরে খতম শেষ না করে অনেক হাফেজের চলে যাবার নজিরও আছে। এক্ষেত্রে মসজিদ কমিটিতে থাকা সদস্যদের আদর্শিক ভিন্নতাও মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
চতুর্থতঃ অনেক মসজিদ কমিটি হাফেজদের ঠিক করে দেন কতোদিনের মধ্যে খতম শেষ করতে হবে। এভাবে ১০/১৫/২০/২৫/২৭ রামাদ্বান পর্যন্ত খতম তারাবিহ পড়ানোর জন্য সময় ফ্রেম নির্ধারিত হয়ে থাকে। ১০/১৫/২০ রামাদ্বানে খতম শেষ করতে গিয়ে সম্মানিত হাফেজদের উপর চাপ পড়ে। উনারা এতো তাড়াহুড়ায় কোরান পাঠ করেন যে আম মুসল্লীর পক্ষে প্রত্যকটা শব্দকে আলাদাভাবে বুঝার কোন উপায় নেই।আবার উল্টো চিত্রও আছে। হাফেজ সাহেবগণ ধীরেসুস্থে তেলাওয়াত করলে মসজিদের মুতওয়াল্লী আপত্তি দেন কিংবা প্রভাবশালী মুসল্লীরা ক্ষেপে যান। কারণ উনাদের দরকার বিশ রাকাত হলো কিনা গূনে শেষ করা কিভাবে শেষ হলো তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
সম্মানিত প্রিয় পাঠকবৃন্দ, কমবেশি এই হলো আমাদের তারাবিহ নিয়ে মাতামাতির চিত্র। সত্যিকার অর্থে আল্লাহর রহমত, বরকত ও মাগফেরাত কামনাকারী মুসলমানের সালাতে তাকওয়া ও পরহেজগারী থাকতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত জনৈক হাফেজ বন্ধুর সাথে আলাপকালে জেনেছি যে মুসল্লীদের অবস্থা বুঝে হাফেজরা ১৫/২০ পারার পর মাঝে মাঝে বাদ দিয়ে যেন সুচতুরভাবে। শুনে খারাপ লেগেছে অসুস্থ এই মন মানসিকতার জন্য। কিন্তু শুধু কি তারাই দায়ী? যারা খতমে তারাবিহ আয়োজন করেন তাদের মন মানসিকতাও এর জন্য কম দায়ী নয়।
এভাবে পবিত্র রামাদ্বান মাসে তারাবিহ নামাজ নিয়ে আমাদের প্রদর্শনী মনোভাবের কারণে পূণ্যের পরিবর্তে আমরা কী নিয়ে রামাদ্বান মাস পার করছি তা উপলব্ধি করা উচিত।
যাঁরা মক্কা-মদিনায় রামাদ্বান কাটিয়েছেন, তারাবিহ সালাত আদায় করেছেন তাঁরা কোরাআন পাঠের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তারাবিহ সালাতে । আমাদের দেশে যেভাবে বুলেট গতিতে তারাবিহ পড়ানো হয় তাতে না হয় স্বাভাবিক নিয়মে পড়ালে যা লাগতো তারচেয়ে আধ ঘণ্টা সময় কম লাগে । কিন্তু এই সামান্য সময়টুকু আমরা মসজিদে বেশি থাকতে রাজী না। নামাজ শেষে কিন্তু আমরা ঠিকই চা দোকানে বসে অহেতুক গালগল্প করে এর দ্বিগুণ তিনগুণ সময় নষ্ট করে ফেলি।
আসলে রামাদ্বান মাসে আল্লাহ শয়তানকে শেকল দিয়ে বন্দী করলেও আমরা আমাদের নফসে আম্মারার গোলামী হতে মুক্ত হতে পারি না। ফলে মাহে রামাদ্বনের নিয়ামত থেকে আমরা বঞ্চিতই থেকে যাই। আল্লাহ আমাদের নফসে আম্মারার উপর নফসে মুতমাইন্নাহকে জয়ী করে দিন।
প্রফেসর সেলিম উদ্দীন-
সাওম আসে আমাদেরকে সংযমের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য। পুরো একমাস রোজা রেখে আমরা যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি তা যেন বছরের বাকী এগারমাস চর্চা করে আমাদের জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি সেটাও সিয়ামের অন্য আরেকটা লক্ষ্য।
কিন্তু আমরা কি সে প্রশিক্ষণ যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারি? সাওম বা সিয়াম আসার সাথে সাথেই আমাদের ব্যক্তিগত,পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ব্যস্ততার মাত্রা আগের তুলনায় কেমন জানি বেড়ে যায়। সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করাতো দূরে থাক ইফতারের সময় আমরা এমনভাবে নানাবিধ উপাদেয় খাদ্য দ্রবাদি উদরস্থ করি সারাদিন খেলেও আমরা এতটুকু খেতে পারতাম কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এ দৃশ্যমান ভক্ষণ প্রতিযোগিতার কারণে রামাদ্বান মাস এলেই আমাদের দেশে নিত্যকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে যায়। এতে করে সাধারণ মানুষ এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে মাহে রামাদ্বান উপলক্ষে মানুষের সুবিধার্থ খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মূল্য হ্রাস হলেও আমরা যেন এ সময় উল্টো পথেই হাঁটি। আমরা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকি বাকী এগারো মাসের ক্ষতি রামাদ্বানে পুষিয়ে নেবার জন্য।
রামাদ্বানে দান খয়রাত থেকে শুরু করে ইবাদত বন্দেগীসহ যাবতীয় পূণ্যকাজে অন্যান্য সময়ের চেয়ে সত্তর গুণ সাওয়াব বেশি।আমাদের মাওলানা ও ইসলামিক স্কলাররা এসব পূণ্যের কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা।একশ্রেণির ধনীরা এর অপব্যবহারে মেতে উঠেন নারকীয় উল্লাসে। যাকাত প্রদানের নামে গরীব মেহনতী মানুষদেরকে যেভাবে হয়রানি করা হয় তাতে লোক দেখানো এসব পূণ্যের ঠিকানা মিলবে কিনা আল্লাহ ভাল জানেন। সামান্য দুইশ টাকার শাড়ি লুঙ্গি বিতরণের নামে অনেক সময় পদদলিত হয়ে নর হত্যার মতো জঘন্য ঘটনাও ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে।
রামাদ্বান আমাদের জন্য যেন আনুষ্ঠানিকতার বার্তা নিয়ে আসে। মাহে রামাদ্বানে ইফতার পার্টির নামে যা চলে তাতে রামাদ্বানের পবিত্রতা কতটুকু বজায় থাকে সেটা বিজ্ঞরাই ভাল বিচার করতে পারবেন। ইফতার পার্টির দৌরাত্ম্যে মাগরিবের নামাজ কখন যে পার হয়ে যায় রোজাদারের সে খেয়াল থাকে না। সালাতের গুরুত্বকে পায়ে মাড়িয়ে ইফতারের পেছনে ছুটে বেড়ায় নামসর্বস্ব উপোসধারী রোজাদার।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দেখা যায় ইফতার পার্টির নামে চলে গানের আসর। নিজেদের তারকা বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করা বিভিন্ন দুনিয়াবী তারকারা যেন মাহে রামাদ্বানের চরিত্র হননের যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের পারিবারিক জীবনেও রামাদ্বান উপলক্ষে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। ওয়ারড্রব ভর্তি কাপড়চোপড় মজুত থাকার পরও রামাদ্বান মাসে নতুন কাপড় কেনার হিড়িক পড়ে যায়। বিশেষত আমাদের মহিলারা মার্কেটিং এর নামে গভীর রাত পর্যন্ত নগরীর প্রতিটি মার্কেটে চষে বেড়ান একা একা কিংবা দলগতভাবে। এতে করে মাহে রামাদ্বানের পবিত্রতা বজায় থাকা দূরে থাক নিজেদের বেলাল্লাপনা দিয়ে আমরা যেন মাহে রামাদ্বানের পবিত্রতা কিভাবে নষ্ট করা যায় তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে রামাদ্বান উপহার নামে নব্য অরাজকতা। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বিশাল আকারে ইফতারি পাঠানো,মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন সবার জন্য কাপড় চোপড় পাঠানো যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। যারা পাঠান না সেসব পিতামাতার মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কটাক্ষ সহ্য করতে হয়। এ নিয়ে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও কম ঘটেনি।এ কারণে আমাদের দেশে স্বল্পআয় ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য রামাদ্বান রহমত,বরকত,নাজাতের পরিবর্তে বাহ্যিকভাবে একবুক কষ্ট নিয়ে আসে যে কষ্টের কথা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে শেয়ার করা যায় না।
হাদিস শরীফে আরো এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না।
এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো।
আল্লাহ তায়ালা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা এ মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)।
কিন্তু আমরা যেন আল্লাহর এ নিয়ামতকে স্বচ্ছায় এড়িয়ে চলার পণ করেছি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক,রাষ্ট্রিয় জীবন কোথাও সিয়াম কিংবা রামাদ্বানের পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখার কোন প্রয়াসই আমাদের মাঝে লক্ষ করা যায় না। যারা এ মাসের পবিত্রতা ও নিয়ামতকে খুঁজে বেড়ান আমাদের সমাজ তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। রোজা রেখে যদি মিথ্যা পরিহার না যায়,সুদ,ঘুষ গ্রহণ বন্ধ না হয়,নানাবিধ অসামাজিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা না যায় তাহলে সে রোজা শুধুই উপোস ছাড়া কিছু নয়।
নবী করীম (সা.) বলেছেন, কেউ যদি (রোজা রেখেও) মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করা (অর্থাৎ উপবাস ও তৃষ্ণার্ত থাকা) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
এই মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ১টি নফল আমল করল সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এই মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করলো।
এটা ধৈর্য্যের মাস। আর ধৈর্য্যের সওয়াব হলো বেহেশত। এটা সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা সেই মাস যে মাসে মুমিন বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তা তার জন্য গুনাহ মাফের এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার ছওয়াব হবে রোজাদার ব্যক্তির সমান। অথচ রোজাদার ব্যক্তির সওয়াব কমবে না।
এসব শুনে সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ রাখেনা যে রোজাদারকে (তৃপ্তি সহকারে) ইফতার করাবে? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ পাক এই ছওয়াব দান করবেন যে রোজাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দিয়ে, অথবা একটি খেজুর দিয়ে, অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাউছার থেকে পানি পান করাবেন যার পর সে পুনরায় তৃষ্ণার্ত হবে না জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত।
আগামী জীবনে আরেকবার রামাদ্বান আসবে কিনা তা আপনি আমি নিশ্চিত নই। তাই সামনে উপস্থিত রামাদ্বানকে মুক্তির পাথেয় হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।
আসুন রামাদ্বানের শিক্ষাকে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্টিত করি। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করুন।
প্রফেসর সেলিম উদ্দীন-
সুবহে সাদিকের সুনসান নিরবতায় নিজেকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করে নিজের চাওয়াকে মিনতিভরা হৃদয়ে উপস্থাপন করার অন্যতম মাধ্যম হলো তাহাজ্জুদ সালাত।
তাহাজ্জুদ (আরবি: تهجد), রাতের নামাজ বা কিয়ামুল লাইল নামেও পরিচিত, ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের জন্যে একটি ঐচ্ছিক ইবাদত। এটা বাধ্যতামূলক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন এবং তাঁর সাহাবীদের এটা পালনে উৎসাহিত করতেন।
আল কুরআনে তাহাজ্জুদ সালাত সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“তারা রাতের সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করে এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৭-১৮)।
আল কুরআনের সূরা আল মুজাম্মিল এ উল্লেখ করা হয়েছে “অবশ্য রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কুরআন পাঠ বা জিকর একেবারে যথার্থ।”
সূরা আল ফুরকান-এর ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।”
“তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থী”। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৭)
আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি। আফজালুস সালাতি বাদাল মাফরুদাতি সালাতুল লাইলি’ অর্থাৎ ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।” হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে রাসূল সা: ফরমাইয়েছেন, ‘আল্লাহ প্রতি রাতেই নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন যখন রাতের শেষ তৃতীয় ভাগ অবশিষ্ট থাকে। তিনি তখন বলতে থাকেন- কে আছো যে আমায় ডাকবে, আর আমি তার ডাকে সাড়া দেবো? কে আছো যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আর আমি তাকে তা দান করব? কে আছো যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করব? (বুখারি ও মুসলিম)
নিজের পাপ,ভুল-ভ্রান্তির জন্য স্রষ্টার কাছ হতে ক্ষমা প্রাপ্তির এই সুবর্ণ সুযোগ আমরা হেলায় হারাচ্ছি। নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতে না পারলেও সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও এ নামাজ পড়ার চেষ্টা করা উচিত। চাকুরীজীবীরা বৃহস্পতিবার রাতে এ নামাজের চেষ্টা করতে পারেন যেহেতু শুক্রবার বন্ধ আছে। এছাড়া সামনে আসছে রমজান। সাহরি খাওয়ার জন্য আমাদের সকলকে উঠতেই হয়। সামান্য একটু চেষ্টা করলে সাহরি খাওয়ার আগে আমরা আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে যেতে পারি। রাতের অন্ধকারে নিরবে নিভৃতে আল্লাহর কাছে চোখের জল ফেলে আমরা আমাদেরকে সহজেই স্রষ্টার নিকটে নিয়ে যাবার সুযোগ পাবো এ নামাজের মাধ্যমে। পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদ সর্বোৎকৃষ্ট আমল। তাহাজ্জুদ নামাজের সঙ্গে সাহরির কার্যত, শব্দগত ও অর্থগত মিল বা সম্পর্ক রয়েছে।
হজরত আলী (রা.) বলেন: যাঁরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভে ঊর্ধ্বারোহণ করেছেন; তাঁরাই সাহার বা শেষ রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়েছেন। (দিওয়ানে আলী (রা), নাহজুল বালাগা)। তাহাজ্জুদ নামাজের আগে-পরে কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা খুবই উপকারী। এ সময় সুরা মুজাম্মিল, সুরা মুদ্দাচ্ছির, সুরা মুলক, সুরা ওয়াকিআহ, সুরা দুখান, সুরা আর রহমান, সুরা ইয়াসিন, সুরা হাশর ও সুরা কাহাফ এবং অন্যান্য সুরা তিলাওয়াত করা অত্যন্ত বরকতময় ও ফলদায়ক। এটি দোয়া কবুলের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। প্রতি রাতে এ সময় আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দার ফরিয়াদ শোনেন।
মধ্যরাতের পরে বা রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়। রাত দুইটার পর থেকে ফজরের নামাজের ওয়াক্ত আরম্ভ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত। সাহরির সময় শেষ হলে তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জমানায় তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য আলাদা আজান দেওয়া হতো। এখনো মক্কা শরিফে ও মদিনা শরিফে এই নিয়ম চালু আছে। তাহাজ্জুদের আজানের পরেও (ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত) সাহরি খাওয়া যায়। তাহাজ্জুদ নামাজ একা পড়াই উত্তম। তাই অন্য সব সুন্নত ও নফল নামাজের মতো তাহাজ্জুদ নামাজের সুরা কিরাআত নিম্ন স্বরে পড়তে হয় এবং এর জন্য ইকামাতেরও প্রয়োজন হয় না।
নফল ইবাদত বিশেষ উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন ছাড়া গোপনে করাই বাঞ্ছনীয়। তবে ‘তাহাজ্জুদ নামাজ অন্ধকারে পড়তে হয়’ বা ‘তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে জিন আসে’ অথবা ‘তাহাজ্জুদ নামাজ শুরু করলে নিয়মিত আদায় করতে হয়’ এ ধারণা সঠিক নয়। তবে কারও ঘুমের ব্যাঘাত যেন না হয় এবং প্রচারের মানসিকতা যেন না থাকে; এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে হবে। তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে পারলে তা অতি উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজের কিরাআত হলো সবচেয়ে দীর্ঘ। এই নামাজে যত ইচ্ছা তত দীর্ঘ কিরাআত পাঠ করা যায়। এতে রাকাত দীর্ঘ করার জন্য এবং তিলাওয়াতের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য একই রাকাতে বিভিন্ন সুরা ও বিভিন্ন আয়াত পড়া যায় এবং একই রাকাতে একই সুরা বারবার অনেকবার পড়া যায়। নফল নামাজে কিরাআতে তিলাওয়াতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি নয়। নফল নামাজে রুকু, সিজদাসহ প্রতিটি রুকন বা পর্ব দীর্ঘায়িত করা সুন্নত ও মোস্তাহাব। এ জন্য রুকু ও সিজদায় তাসবিহ অনেক অনেকবার পড়া যায় এবং অন্যান্য পর্বে বেশি পরিমাণে বিভিন্ন দোয়া মাসুরা (যা কোরআন ও হাদিসে আছে) পাঠ করা যায়।
আসুন, আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ ফজিলতপূর্ণ এ নামাজ পড়ে নিজেদের মুক্তির পথকে সহজ করি এবং পরিবার পরিজনকেও উৎসাহিত করি।
চট্টগ্রাম শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ আহম্মদ শফীর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
আজ সোমবার (১৩ এপ্রিল) বিকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
তিনি জানান, হেফাজত আমীরের যে করোনায় মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছে, তা সঠিক নয়। তিনি আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। তাঁর চিকিৎসা চলছে। শতবর্ষী প্রবীণ আলেম আল্লামা আহমদ শফী বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন।
মাওলানা ইসলামাবাদী জানান, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে গত ১১ এপ্রিল আল্লামা শাহ আহম্মদ শফীকে চট্টগ্রামের সিএসসিআর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি দেশবাসীর কাছে আল্লামা শাহ আহম্মদ শফীর সুস্থতা কামনায় দোয়া চেয়েছেন।
প্রফেসর মো: সেলিম উদ্দিন-
প্রায়শঃ বিভিন্ন মুসল্লী কিংবা মুরব্বীদের হাতে তাসবিহ দেখি। শৈশবের দিনগূলোতে গ্রামের মসজিদে বেশি দেখতাম। কেউ কেউ হাতের আঙুলে তাসবিহ গুনেন। সাধারণ নামাজ শেষে তাসবিহ পাঠ করতে দেখা যায়। অনেকে আবার অবসরেও তাসবিহ পাঠ করেন।উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ। পূণ্যলাভের নিমিত্তে সাধারণত তাসবিহ পাঠ করা হয়ে থাকে।অনেকে নামাজের পর এতো তাড়াহুড়ায় থাকেন পাঁচ মিনিট ব্যয় করতে পারেন না তাসবিহ পাঠের জন্য। তারা জানেন না কী নিয়ামত থেকে তারা প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছেন।
আল্লাহর প্রশংসা বাক্যই হলো তাসবিহ। তাঁর নামের তাসবিহ যে কত মধুর ও শান্তিদায়ক তা আল্লাহ প্রেমিকরাই উপলব্ধি করতে পারে। যে বা যারা ব্যক্তি জীবনে একবার হলেও তাঁর প্রেমে তাসবিহ পড়েছেন কিংবা তাঁর তাসবিহ-এর স্বাদ গ্রহণ করেছেন; তারাই জানেন যে আল্লাহর তাসবিহতে কি স্বাদ বা মহত্ম নিহিত রয়েছে।
আল্লাহ তাআলার তাসবিহ মূলত মানুষের মনের সুখ ও শান্তি লাভের এক অনন্য মহৌষধ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যারা বিশ্বাস করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়। জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণের (এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, উহা) দ্বারা অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। (সুরা রাদ : আয়াত ২৮)
অন্তরের প্রশান্তি লাভের পাশাপাশি আল্লাহর তাসবিহ আদায়ে দুনিয়া ও পরকালে বান্দার জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিদান। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে ছিলাম। এ সময় তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমাদের কেউ কি একদিনে এক হাজার নেকি অর্জন করতে সক্ষম? তাঁর সঙ্গে বসা লোকদের কেউ কেউ বললেন- ‘আমাদের কেউ কিভাবে একদিনে এক হাজার নেকী আদায় করতে সক্ষম হবেন?
তখন তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, কেউ যদি একদিনে ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ (سُبْحَانَ الله) পড়ে তাহলে তার জন্য এক হাজার নেকি লেখা হবে অথবা তার এক হাজার গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে হিব্বান, তারগিব)
আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) পিতার কাছে একজন দাসী চাইলে পিতা অপারগতা প্রকাশ করেন এবং পরে ফাতেমার গ্রহে গিয়ে আল্লাহর রাসুল বলেন – আমি কি তোমাকে এমন একটি জিনিস দেব যা তুমি যা চেয়েছো তারচে’ উত্তম? ফাতেমা (রাঃ) বললেন- অবশ্যই।
নবীজী (সাঃ) বললেন- এই কথাগুলো আমাকে জিবরাইল(আঃ) শিখিয়েছেন। প্রত্যেক নামাজের পর দশবার সুবহানাল্লাহ,দশবার আলহামদুলিল্লাহ, দশবার আল্লাহু আকবর পড়বে এবং রাতে যখন ঘুমোতে বিছানায় যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ,৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর পড়বে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে এই হাদিসের উল্লেখ আছে।
হয়রত আলী (রাঃ)একদা বলেন এই আমল আমি সর্বদা অনুসরণ করেছি। এমনকি সিফফিনের কঠিন যুদ্ধের সময়ও।
নামাজ শেষ করার পর তাসবিহ পাঠ করলে বিপদাপদ দূর হয়। অন্তরের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। তাসবিহ পাঠকারীর মনের প্রশান্তি ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। হাদিসে হজরত কাব ইবনে উজরা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক ফরজ নামাজের পরে পাঠ করার জন্য কতিপয় উত্তম বাক্য রয়েছে, সেগুলো যারা পাঠ করবে তারা কখনও নিরাশ হবে না। ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার।’ –সহিহ মুসলিম
তাসবিহ হলো গোনাহ মাফের দাওয়া। নামাজ শেষে তাসবিহ পাঠ করলে গোনাহ মাফ হয়। তাসবিহ পাঠের ফলে আল্লাহতায়ালা খুশি হয়ে বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে আল্লাহ তার সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন, যদিও গোনাহ সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।’ –সহিহ মুসলিম
নামাজ শেষে তাসবিহ পাঠ করলে সওয়াবও বেশি পাওয়া যায়। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়েছে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে আল্লাহর জিকির করেছে, তারপর দু’রাকাত নামাজ পড়েছে, তার জন্য হজ ও উমরার সওয়াবের ন্যায় সওয়াব রয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা প্রমাণ করে তাসবিহ পাঠ কত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের অনেকে এত দ্রুত তাসবিহ পাঠ করেন যে তা সহীহভাবে উচ্চারিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে কোনপ্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই।যেন শুধু নামকোওয়াস্ত পাঠ করে যাওয়া।
তাসবিহ পাঠ যদি এখলাছের সাথে খোদাভীরুতা নিয়ে পাঠ করা না হয় তাহলে কি কাংখিত সওয়াব পাওয়া যাবে? এত সহজ একটা আমল দুনিয়াবি ব্যস্ততার কারণে কত তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহকারে করা হচ্ছে!
সালাত শেষে অনেককে দেখি হাতের আঙুলে তাসবিহ পাঠ করছেন। কিন্তু এতো দ্রুত আঙুলের কড়িতে গুনা শেষ করেন যেন নিজেই জানেন না কী পড়লেন। উপরোক্ত তাসবিহ ছাড়াও আরো অনেক আমল আছে যাতে অসীম সাওয়াব রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে আমরা সেগুলো আমল করে নেকীর পাল্লাকে ভারী করতে পারি খুব সহজেই।
বুখারী শরীফের ৭০৫৩ নং হাদীসে উল্লেখ আছে-আহমাদ ইবনু আশকাব (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দুটি কলেমা (বানী) রয়েছে, যেগুলো দয়াময় আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়, উচ্চারণে খুবই সহজ (আমলের) পাল্লায় অত্যন্ত ভারী। (বানী- দুটি হচ্ছে), সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহান্নাল্লাহিল আযীম-আমরা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি, মহান আল্লাহ অতীব পবিত্র।
এসব আমলের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে পুতঃপবিত্র রাখতে পারি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথকে সহজ করতে পারি অনায়াসে। আসুন আমাদের জীবননে পরকালের জন্য প্রস্তুত করি।কঠিন দিনের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করি।
শেরপুরে আগামী ২৪ ও ২৫ অক্টোবর খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ২২তম ফাতেমা রাণীর তীর্থোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী বারমারীস্থ ‘সাধু লিওর খ্রীষ্টান ধর্মপ্লী’র সভা কক্ষে নিরাপত্তা বিষয়ক এক প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এতে তীর্থ উদযাপন কমিটির সমন্বয়কারী রেভারেন্ট ফাদার মনিন্দ্র এম. চিরানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, নালিতাবাড়ী সার্কেল এএসপি মো. জাহাঙ্গীর আলম, নালিতাবাড়ীর সহকারী কমিশনার (ভুমি) লুবনা শারমিন প্রমূখ।
অন্যান্যের মাঝে নালিতাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বছির আহমেদ বাদল, নয়াবিল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি নুর ইসলাম, ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুছ আলী দেওয়ান, নিরাপত্তা কমিটির কনভেনার রেভারেন্ট ফাদার ফিদেলিস নেংমিনজা, বিজিবি প্রতিনিধি হাবিলদার মিজানুর রহমান ও জনমাংসাং প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভায় অতিথিরা বলেন, ময়মনসিংহ বিভাগের খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের এবারের তীর্থোৎসবে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য একজন নির্বার্হী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার বাহিনীসহ উল্লেখযোগ্য আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনসহ সিসিটিভি ক্যামেরার আওয়াতায় আনা হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৪২ সালে প্রায় ৪২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত বারমারী সাধু লিওর এ ধর্মপল্লীটি ১৯৯৮ সালে পর্তুগালের ফাতেমা নগরীর আদলে ও অনুকরনে পাহাড় ঘেরা মনোরম পরিবেশে তৈরী হওয়ায় এটিকে বার্ষিক তীর্থ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়।
উৎসবে বৃহস্পতিবার বিকেলে পাপ স্বীকারের মাধ্যমে শুরু হবে মূল ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এরপর পবিত্র খ্রীষ্টযাগ, রাতে উৎসবের প্রধান আকর্ষণ আলোক শোভাযাত্রা এবং মধ্যরাতে সাক্রান্তের আরাধনা, নিশি জাগরণ ও নিরাময় অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে প্রথম দিনের উৎসব শেষ হবে।
পরদিন শুক্রবার সকাল ৮ টায় জীবন্ত ক্রুশের পথ ও সকাল ১০টায় মহা খ্রীস্টযাগের মাধ্যমে তীর্থোৎসবের সমাপ্তি হবে। এছাড়া উৎসবের পাশের মাঠে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত আদিবাসীদের নানা পসড়ার মেলাও বসবে।
মানুষ ও জ্বীন জাতিকে সৃজন করা হয়েছে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও গোলামী করার জন্য। পবিত্র কুরআনে পাকে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এ জন্য যে তারা যেন আমারই ইবাদত করে” (সূরা আল-জারিআত- ৫৬)। এই কারণে আল্লাহর কাছে নফল ইবাদতের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি।
হিজরি সালের ১০ম মাস তথা রমজানের পরবর্তী মাস ‘শাওয়াল’। এ মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখা সুন্নাত, যদিও তা শরীয়তী পরিভাষায় ‘নফল’ হিসেবে পরিচিত। হাদিস শরীফে এর বহু ফজিলতও বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখলো, এরপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখলো, সে যেন গোটা বছর রোজা রাখলো” (সহিহ মুসলিম)। হযরত সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “রমজানের রোজা দশ মাসের আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দু’মাসের রোজার সমান, সব মিলিয়ে এক বছরের রোজা” (নাসায়ী শরিফ)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, “রমজান মাসের রোজা হচ্ছে ১০ মাসের সমান। আর ছয় দিনের রোজা হচ্ছে দুই মাসের সমান। এভাবে এক বছরের রোজা হয়ে গেল” (সহিহ ইবনে খুজাইমা)।
উপযুক্ত হাদিসে বলা হয়েছে, রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়ালের ৬টি রোজা রাখলে সারা বছর রোজা রাখার সাওয়াব পাওয়া যাবে। হিসেবটি হলো এরূপ- আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “যে ১টি নেক আমল করবে, সে ১০ গুণ সাওয়াব পাবে” (সূরা আনআম- ১৬০)। আর এ হিসেবে মাহে রমজানের ৩০ টি ফরজ রোজায় ৩০০ রোজার সাওয়াব পাওয়া যাবে (৩০*১০=৩০০)। অন্যদিকে মাহে শাওয়ালের ৬টি রোজায় ৬০ রোজার সাওয়াব পাওয়া যাবে (৬*১০=৬০)। তাহলে দেখা যায়, মাহে রমজানের ৩০ রোজার বিপরীতে ৩০০ রোজা ও মাহে শাওয়ালে ৬ রোজার বিপরীতে ৬০ রোজার সাওয়াব পাওয়া যাচ্ছে, মোট ৩৬০ রোজার সাওয়াব। আমরা জানি, ৩৬০ দিনে হিজরি বা চন্দ্র এক বছর হয়ে থাকে। তাই মাহে রমজানের ৩০ রোজা ও মাহে শাওয়ালে ৬ রোজা আদায় করলে এক বছর রোজার সাওয়াব পাওয়া যায় (সুবহান আল্লাহ)।
একজন মানুষ ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি অধিকহারে নফল ইবাদত করতে করতে আল্লাহর বান্দা হতে বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। নফল ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহ নৈকট্য লাভ করা যায়। হযরত হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমেরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সহ বিশ্ব বিখ্যাত যত অলি-বুজুর্গ রয়েছেন, তাদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা প্রচুর পরিমাণে নফল ইবাদতে সময় ব্যয় করেছেন। আর এ কারণেই তাঁরা সকলেই আল্লাহ নিকটবর্তী হয়েছেন। তাদের ইন্তেকালের পরও ভিন্ন দেশ থেকে তাদের আলোচনা করা হচ্ছে। কুরআনুল কারিমে এসেছে, “আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেন না” (সূরা ইউনুস- ৬২)।
আসুন, মাহে রমজানে সকল রোজা সঠিকভাবে আদায়ের পর মাহে শাওয়ালে ৬টি রোজা রাখার নিয়ত করি। শাওয়াল মাসের পহেলা তারিখ তথা ঈদুল ফিতর দিবস ব্যতীত শাওয়ালের সকল দিবসের মধ্যে এ নফল রোজা রাখা যাবে। আল্লাহ আমাদের সকলের মাহে রমজানের ফরজ রোজা কবুল করুন ও শাওয়ালের ৬টি রোজা থাকার তাওফিক প্রদান করুন, আমিন।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য বিভাগের প্রফেসর হুসেইন আসকারি ইসলামের বিধান মেনে চলার ব্যাপারে গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছেন।
তিনি তার গবেষণায় দেখার চেষ্টা করেছেন, বিশ্বের কোন দেশগুলোতে দৈনন্দিন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামি বিধান মেনে চলা হয়। গবেষণার নমুনায় দু’শ আটটি দেশের মধ্যে দেখা গেছে ইসলামি রীতি মেনে চলা দেশের তালিকার শীর্ষে ইসলামি কোনো দেশের নাম নেই।
গবেষক হুসেইন আসকারি বলেন, মুসলিম দেশগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইসলামি আইন ব্যবহার করে অতচ তালিকার ৩৩ নম্বরে রয়েছে মালয়েশিয়া, কুয়েত রয়েছে ৪৮, বাহরাইন ৬৪ এবং সৌদি আরব রয়েছে ১৩১ নম্বরে।
এমন অনেক দেশ আছে; যেগুলো ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। তবে সেখানকার সমাজে ইসলামি আইন মেনে চলা হয় না, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, এমনকি ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড চলছে সেখানে।
গবেষণার ফলাফলে দেখানো হয়েছে, সমাজে ইসলামি বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও বেলজিয়াম তালিকার শীর্ষে রয়েছে।
অন্যদিকে তথাকথিত ইসলামি দেশগুলোতে মুসলমানরা নামাজ আদায় করেন, রোজা রাখেন, কোরআন-হাদিস পড়েন, নারীরা পর্দা মেনে চলে, দাড়ি রাখার সংখ্যা বেশি, ইসলামি পোষাক নিয়ে সচেতন; তবে সমাজে দুর্নীতি আর পেশাগত জীবনে অসদুপায় অবলম্বনের নজির চতুর্দিকে।
এর আগে ২০১০ সালেও এক গবেষণায় ইসলামি বিধান মেনে চলা দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে ইসলামি রাষ্টের নাম ছিল না। ওই গবেষণায় নিউজিল্যান্ড, লাক্সেমবার্গ, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নেদারল্যান্ড ছিল তালিকার শীর্ষে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে,যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে আগামী শনিবার (১ জুন) দিবাগত রাতে সারাদেশে পবিত্র লাইলাতু্ল কদর বা শবে কদর পালিত হবে। এ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শনিবার বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে শবে কদরের রাত হাজার রাতের চেয়ে পুণ্যময়। মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘হাজার রাতের চেয়েও উত্তম’ পবিত্র শবে কদর সমগ্র মানব জাতির জন্য অত্যন্ত বরকতময় ও পুণ্যময় রজনী। পবিত্র শবে কদরের রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহ’র নৈকট্য ও রহমত লাভের আশায় ইবাদত বন্দেগী করবেন।
পবিত্র রমজান মাসে লাইলাতুল কদরে পবিত্র আল কোরআন নাজিল হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ শনিবার দিবাগত রাতে মসজিদসহ বাসা-বাড়িতে এবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। এ রাতে মুসলমানগণ নফল নামাজ আদায়, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আসকার, দোয়া, মিলাদ মাহফিল ও আখেরি মোনাজাত করবেন। পবিত্র শবে কদর উপলক্ষে রবিবার সরকারি ছুটি।এ উপলক্ষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে রাতব্যাপী ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় বয়ান ও আখেরি মোনাজাতের আয়োজন করা হবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আজ বলেন, ‘১ জুন শনিবার দিবাগত রাতে সারাদেশে পবিত্র লাইলাতুল কদর পালিত হবে।’
তিনি বলেন, এ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শনিবার বাদ জোহর (বেলা দেড়টায়) বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ‘পবিত্র লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য’ শীর্ষক ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। ওয়াজ পেশ করবেন মিরপুর বায়তুল মামুর জামে মসজিদের খতিব ড. মুফতি আবদুল মুকিত আযহারী।
জাতীয় মসজিদসহ দেশের সব মসজিদেই তারাবীর নামাজের পর থেকে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন থাকবে।
পবিত্র শবে কদর উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি রেডিওসমূহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। এছাড়া সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে।